Haleem

হালিমের হালহকিকত! রমজান পেরিয়ে ইফতারি নাস্তার প্রবেশ অবাধ বর্ষবরণের আড্ডাতেও

খাওয়ার বিষয়ে বাঙালি সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস খুব একটা দেখায়নি। বিরিয়ানি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বলা যেতে পারে, হালিম এখন হয়ে উঠছে জেন জ়ি বাঙালির বিরিয়ানি সমান!

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:০৭
Share:

যত দিন যাচ্ছে, বাঙালির হালিমের প্রতি টান বাড়ছে। ছবি: শাটারস্টক।

বিকেলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে হালিমের হাঁড়ি খালি হয়ে যায়। ধর্মতলার মোড়ের কাছের বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের নিউ আলিয়া হোটেলে তখন যত বড় লাইনই থাক না কেন, আর কিছু করার থাকে না। খালি হাতে ফিরতে হয় সকলকে। ইফতারিদের ভিড় তুলনায় কম। আশপাশের অফিস ফেরত জনতার উৎসাহই বেশি। বহু দিন হল কলকাতা বিরিয়ানিকে বাঙালি বানিয়েছে। বিরিয়ানির চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর হয়ে উঠেছে আমিনিয়া, আরসালান, সিরাজ, রয়্যাল এবং শহরের নানা প্রান্তের আরও বহু মোগলাই খানার ঠিকানা। তবে রমজান মাসটা আলাদা। শুধু বিরিয়ানি-কবাবে আটকে থাকে না কলকাতা। যত দিন যাচ্ছে, হালিমের প্রতি টান বাড়ছে। এক কালে এ শহর ততটাও পরিচিত ছিল না রমজান মাসে উপোস ভাঙার জন্য বিখ্যাত এই রান্না। কলকাতায় যে পাওয়া যেত না, তা নয়। সারা দিনের উপোস ভাঙার পরে রকমারি ডাল আর মাংস দিয়ে তৈরি পুষ্টিকর এই খানা মূলত খেতেন ইফতারিরাই। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের উৎসাহ সে ভাবে ছিল না। গত কয়েক বছরে এ শহরের খাদ্যাভ্যাসে বদল এসেছে অনেক। বিরিয়ানি, চাঁপ, রেজ়ালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে এগিয়ে এসেছে রীতিমতো নায়কের ভূমিকা দখল করার জন্য তৈরি হয়েছে হালিম। রমজান শেষেও ইফতারি এই নাস্তাকে বিদায় জানাতে চায় না কলকাতা শহর। বরং নানা অছিলায় হালিমকে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে নববর্ষের ভোজের অঙ্গ হিসাবেও।

Advertisement

হালিম মূলত মরসুমি রান্না। রমজান মাসেই সাধারণত পাওয়া যায়। এ সময়ে উপোস রাখা হয়। গরমের মধ্যে গোটা দিনটা খাবার এবং জল ছাড়া কাটিয়ে সকলেরই শক্তি সঞ্চয় করার মতো কিছু দরকার হয়। হালিম তার জন্য একেবারে উপযুক্ত। ডাল আর মাংসের মেলবন্ধনে তৈরি একটি খাবার। অর্থাৎ, প্রোটিনে ভরপুর। সঙ্গে ফাইবার আর কার্বোহাইড্রেটও থাকে যথেষ্ট পরিমাণে। উপোস ভাঙার পরে এক বাটি হালিম খেয়ে নিলেই হল। বাকি দিনটা চাঙ্গা থাকা যাবে। পেটও ভর্তি থাকে সহজে।

আরব দুনিয়ায় জন্ম হালিমের। বহু শতক আগে থেকেই আবর দেশগুলিতে এ রান্নার চল। প্রাচীন বাগদাদের একটি রান্নার বইতেও হালিমের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইরানে এখনও এই রমজানি রসনা জনপ্রিয়। আর সময়ের সঙ্গে তা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেও। অনেকে বলেন, হায়দরাবাদের নিজ়ামের সেনাদের দৌলতেই এককালে এই উপমহাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল হালিম খাওয়ার চল। তবে কলকাতা শহর হালিমকেও চেনে অঔধি খানা হিসাবেই। হায়দরাবাদি বিরিয়ানির সঙ্গে যেমন অনেক ফারাক কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানির, হালিমের ক্ষেত্রেও গল্পটা খানিক তেমন।

Advertisement

হায়দরাবাদের হালিম সাধারণত বেশ মশলাদার হয়। দক্ষিণ ভারতীয় মশলা তাতে বেশি। আর মাংস থাকে ডালের সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে। অন্য প্রান্তের হালিমে আবার মাংসের টুকরো মুখে পড়ে। বিশেষ করে উত্তর ভারতের হালিম তেমনই।

নানা গল্পে শোনা যায়, অঔধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় আসার পরেই এ প্রান্তে হালিম খাওয়ার চল বাড়ে। তবে নবাবের প্রপৌত্রী মনজ়িলত ফতিমা বলেন, ‘‘হালিম ঠিক অঔধি খানা নয়। লখনৌতে সাধারণত খিচড়া রান্না হয়। তবে আমাদের ঘরোয়া হালিমের রেসিপি আছে।’’ মনজ়িলতের রেস্তরাঁয় তাঁর মায়ের সেই রেসিপিই এখন তৈরি হয়।

নবাবের বাড়ির হালিমের সেই প্রণালী এখন বেশ জনপ্রিয় সাধারণের মধ্যে।

নানা অছিলায় হালিমকে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে নববর্ষের ভোজের অঙ্গ হিসাবে। ছবি: আমিনিয়া।

২০১৭ সালে রমজান মাসে শুধু ঘরোয়া ভাবে সেই হালিম রান্না দিয়েই পথ চলা শুরু হয়েছিল মনজ়িলতের রেস্তরাঁর। তিনি জানান, সে বছর দিনে ৩০-৪০ প্লেট করে বিক্রি হত। বছর সাতেকের মাথায় গিয়ে এখন ১০০-১৫০টি প্লেট তো বানানই। সঙ্গে অনেকের আবেদন ফিরিয়েও দিতে হয়। কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে হালিমের চাহিদা। এক এক প্লেটের দাম এই ক’বছরে ১৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৫০ টাকা।

এ বছর কয়েক জায়গা থেকে পয়লা বৈশাখের দিন হালিম তৈরি করে দেওয়ার অর্ডার আছে। মনজ়িলত ঠিক করেছেন, সকলে যখন এই খাবার এত ভালবাসছেন, তখন আর শুধু রমজানে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। হালিম মূলত ইফতারি নাস্তা হলেও এ শহরে তার চাহিদা অন্য রকম। ইফতারিদের থেকে বেশি অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা কেনেন। ফলে এ বার তো নববর্ষে হালিমের জোগান দেবেনই, এর পরে চেষ্টা করবেন যাতে সারা বছরই রাখতে পারেন এই রান্না।

সারা বছর এমনিতে হালিম বিক্রির চল নেই কলকাতা শহরের নামী মোগলাই রেস্তরাঁগুলিতে। পাকিস্তানে হালিম বেশ নিয়মিত সান্ধ্য আড্ডার সময়ে খাওয়ার জিনিস। সারা বছর পাওয়া যায়। এ দেশে তেমনটা নয়। তবে কলকাতার বাঙালি অন্য রকম। যা কিছু মোগলাই, তার প্রতিই টান। ফলে বাঙালির রসনাবিলাসে নিত্য জোগান দিতে অন্য পন্থা নিয়েছে অঔধ ১৫৯০। সারা বছর সেখানে ডাল গোস্ত নামে একটি পদ রাখা হয়। কর্ণধার শিলাদিত্য চৌধুরী জানান, ডাল গোস্ত হালিমের মতোই খেতে। শুধু কলকাত্তাইয়া হালিমের তুলনায় একটু থকথকে। দুবাইয়ে বেশ জনপ্রিয় এই রান্না। এখন কলকাতারও পছন্দের। নববর্ষের শহরে লখনৌ ঘরানার পরোটার সঙ্গে ২৭৫ টাকায় পাওয়া ডাল গোস্তই রমজান শেষে হালিম হারাদের দুঃখ ঘোচাবে।

হালিম এখন হয়ে উঠছে জেন জ়ি বাঙালির বিরিয়ানি সমান! ছবি: মনজ়িলত ফতিমা।

এমনিতে এ শহরে ইফতারিদের থেকে বেশি অন্যদেরই টান পাঁচমিশেলি ডাল আর মাংস দিয়ে তৈরি মশলাদার এই খাবারের। দিন দিন মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে, ফলে সারা দিন খালি পেটে থেকে উপোস ভাঙার পরে অনেকেই আর মশলাদার হালিম বেশি খেতে চান না। তবে তাতে হালিমের বিক্রি কমে না। জ়্যাম জ়্যাম রেস্তরাঁর কর্তা শদমান ফইজ় যেমন জানান, গোটা রমজান মাসে প্রতি দিন তাঁদের তিনটি দোকান থেকে ২০০০ থেকে ২৫০০ প্লেট হালিম এখন বিক্রি হয়। তিনি বলেন, ‘‘২২ বছর আগে যখন আমরা শুরু করেছিলাম, তখন সকলে এত হালিমের জন্য আসতেন না। বেশি আসতেন বিরিয়নি, কবাব খেতে। এখনকার প্রজন্ম হালিম খুব পছন্দ করছে।’’ কম বয়সিদের কথা ভেবে, তাঁদের মনজয় করতে রকমারি হালিমও রাখতে শুরু করেছেন শদমানরা। চিকেন টিক্কা হালিম, চিকেন চটপটা হালিম, চিকেন ভর্তা হালিম তার মধ্যে অন্যতম। দাম ১৮০ টাকা। ইচ্ছা করেই তরুণদের আয়ত্তের মধ্যে রাখা হয়।

কলকাতার তরুণদেরই যে বেশি ভিড় জমে বিকেলের হালিম কেনার লাইনে, তা এক কথায় মানছেন আমিনিয়ার এক কর্তা মহম্মদ আজ়হারও। ১৯২৯ সালে আমিনিয়ার প্রথম রেস্তরাঁটি চালু হয় নাখোদা মসজিদের কাছে। সেখানে আজ়হারের ঠাকুরদাদা আব্দুল রাহিম হালিম বিক্রি শুরু করেন। সে সময়ে কলকাতায় শুধু ইফতারিরাই হালিম খেতেন। আমিনিয়ার ব্যবসা বেড়েছে। তবে মূলত বিরিয়ানি-কবাবের টানেই। তার পর বহু বছর তেমনই চলেছে। একের পর এক আমিনিয়া তৈরি হয়েছে কলকাতার নানা প্রান্তে। বিরিয়ানির জন্য ভিড়ও জমে নিয়মিত। কিন্তু গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। আজ়হার বলেন, ‘‘বছর ছয়েকে আমাদের হালিমের ব্যবসা প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এখন শুধু নিউ মার্কেট চত্বরের আমিনিয়া থেকেই দিনে ২০০০ প্লেট হালিম বিক্রি হয়।’’

তা-ও তো সারা দিন হালিম পাওয়া যায় না। সাবেক মেজাজে চলা মোগলাই রেস্তরাঁগুলি রমজান মাসে বিকেল ৩টে থেকে হালিম বিক্রি শুরু করে। রাত ৮টার মধ্যে গুটিয়ে ফেলে বিক্রি। অধিকাংশ জায়গায় তত ক্ষণও থাকে না। চাহিদার চেয়ে এখনও জোগান কম। তাড়াতাড়ি তাই শেষ হয়ে যায়। সারা রাত ডাল ভিজিয়ে রেখে দিনভর দম দিয়ে তৈরি হয় অমৃত সমান সেই রান্না। আর যাতে দরদ যত বেশি, বাঙালির জিভের তার প্রতিই টান বেশি। খাওয়ার বিষয়ে বাঙালি সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস খুব একটা দেখায়নি। বিরিয়ানি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বলা যেতে পারে, হালিম এখন হয়ে উঠছে জেন জ়ি বাঙালির বিরিয়ানি সমান!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement