পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা মা দক্ষিণ কলকাতার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যখন ১০ কিলোমিটার হেঁটে বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছলেন, তখন রাত গড়িয়েছে অনেকটা। লকডাউনে ঘুমন্ত শহর তাঁর হাঁটা থামাতে পারেনি। পথের ভয় নয়, তখন তাঁকে তাড়া করেছিল চার দেওয়ালে থাকার বিভীষিকা।
আরও একটি ঘটনা বুঝিয়ে দেয় যে দীর্ঘ লকডাউন পর্বে গার্হস্থ্য হিংসার বলি হয়েছেন অবিবাহিত মেয়েরাও। চাকরি সূত্রে দিল্লিতে থাকেন মেয়েটি। লকডাউনে কলকাতার বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। তখনই মায়ের উপর অত্যাচার হতে দেখে প্রতিবাদ করেন তিনি। পরিণামে তাঁরও জুটেছিল মারধর। গার্হস্থ্য হিংসার এমন অভিযোগ গত চার মাসে ভূরি ভূরি এসেছে।
এ দেশে প্রতি বছর এই হিংসার বলি হন সাড়ে আট হাজারের বেশি মহিলা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো (এনসিআরবি) ২০১৮-র রিপোর্ট বলছে, তাঁদের মৃত্যুর কারণই হল স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার! গার্হস্থ্য হিংসার নথিভুক্ত হওয়া তথ্যও চমকে দেওয়ার মতো। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস) ২০১৪-১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে প্রতি তিন জন মহিলার এক জন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার!
অভিযোগ জানাতে যোগাযোগ
• রাজ্য মহিলা কমিশন ৯৮৩০৯৪৭২৪৭
• উইমেন্স গ্রিভান্স সেল ০৩৩-২২১৪৫০৪৯
• কলকাতা পুলিশ ০৩৩-২২১৪১৪২৯
• স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ৯৮৩০০৭৯৪৪৮, ৯৮৩০৭৪৭০৩০
কোভিড আবহে সেই হিংসাই ছড়িয়েছে মহামারির মতো। শুধু পরিসংখ্যান বৃদ্ধিই নয়, বেড়েছে অত্যাচারের মাত্রাও। কিন্তু অভিযোগ জানাতে কোথায় যাবেন সেই মহিলারা? সেটাই তো এখনও স্পষ্ট নয়! কারণ, জাতীয় স্তরে মেয়েদের ১৮১ হেল্পলাইন নম্বরের কথা বলা হলেও অনেক রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও কার্যত তার কোনও অস্তিত্ব নেই! স্বাভাবিক সময়ে অত্যাচারিত হলে তিনি বাবা-মা বা নিজের পরিবারের কাউকে ফোন করে বা তাঁদের ডেকে আনিয়ে, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে পৌঁছে গিয়ে সাহায্য চাইতেন। লকডাউনে এই সাহায্যগুলি পেতে যে সমস্যা সেটাই কাজে লাগিয়েছেন এক শ্রেণির মানুষ।
শিশুদের জন্য দেশ জুড়ে একটি হেল্পলাইন ১০৯৮-এর অস্তিত্ব জানেন সকলে। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা কেন, সে উত্তর একমাত্র প্রশাসনই দিতে পারবে। সাহায্য পেতে রাজ্য মহিলা কমিশন এবং কলকাতা পুলিশের উইমেন্স গ্রিভান্স সেলেও অভিযোগ জানাতে পারেন। পাশাপাশি আমাদের সংস্থার নিজস্ব হেল্পলাইন নম্বরও রয়েছে। সেখানেও ফোন করতে পারেন। এমনকি তাঁদের কাউন্সেলিং-এর জন্য আলাদা হেল্পলাইন নম্বরও রয়েছে আমাদের। যেখান থেকে তাঁরা আইনি ও নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শ এবং পুলিশি সাহায্য পেতে পারেন। অথচ অধিকাংশ মহিলাই সে সব জানেন না। এটাই বড় সমস্যা।
লকডাউনে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে দেখে এফএম-এর মতো প্রচার মাধ্যমে হেল্পলাইন নম্বরের প্রচার করা হয়েছিল। পাশাপাশি প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের দিয়ে সচেতনতার বার্তা-সহ সেই নম্বর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছিল। যাতে ফোনে সাহায্যের বিষয়টি অন্তত মহিলারা জানতে পারেন।
যার খানিকটা ফল মিলেছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুনে হেল্পলাইন নম্বরের মাধ্যমে কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে আমাদের অফিসে ৩৪৫টি নতুন অভিযোগ জমা পড়েছিল। আগের ৯৬৪টি অভিযোগ তো ছিলই।
মহামারি পর্বে মহিলাদের উপরে অত্যাচার বৃদ্ধির এই প্রবণতা বিশ্ব জুড়েই বাড়তে দেখা গিয়েছে। অন্যতম কারণ, পরিবারের সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই অশান্তি বেড়েছে। এই সময়ে মেয়েদের বাড়ির কাজ বেড়ে গিয়েছে। তারই মধ্যে পরিবারের অন্য সদস্যদের তাঁদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার মনোভাব নারী-মনে চাপ তৈরি করছে, চাকরি হারিয়ে মেয়েদের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত পুরুষদের একাংশের কাছে ক্ষোভ বহিঃপ্রকাশের সহজ মাধ্যম এখন চোখের সামনে থাকা পরিবারের মহিলা। এর কুপ্রভাব পড়ছে পরিবারের শিশুদের উপরে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শৈশব। নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণির নয়, সর্বস্তর থেকে আসছে এমনই অভিযোগ।
আরও পড়ুন: ডায়াবিটিস আছে? করোনা আবহে সতর্ক না হলে ফল হতে পারে বিপজ্জনক