সতর্কতা ও সচেতনতার প্রচার তো প্রায় নেই-ই। সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ সম্পর্কে এত দিনেও নিজে থেকে কোনও ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি রাজ্য সরকার। এই অবস্থায় ওই মারণ রোগের স্বরূপ সম্বন্ধে আমজনতা বিভ্রান্ত। এবং সেই বিভ্রান্তি আসলে রোগটির প্রকোপ বৃদ্ধিতেই সাহায্য করছে বলে অনেক চিকিৎসকের অভিমত।
বিভ্রান্তির কারণ কী?
সংবাদপত্রে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশিকা এবং সোয়াইন ফ্লু সম্পর্কে চিকিৎসকদের মতামত পড়ে উপসর্গ সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। সেই ধারণা থেকেই অল্পবিস্তর সচেতন হয়ে হাসপাতালে সোয়াইন ফ্লু-র পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন তাঁরা। আর সেখানে গিয়েই নানা বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলির জন্য স্বাস্থ্য ভবন থেকে প্রচার করা সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার বিধিই এই বিভ্রান্তির কারণ বলে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ।
সংক্রামক রোগের চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, মানুষ যেখানে নিজে থেকেই সচেতন হয়ে পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন, সেখানে বিভ্রান্তিকর বিধি দেখিয়ে মানুষকে ফিরিয়ে দিলে রোগের সংক্রমণ তো কমবেই না। বরং ক্রমশই তা আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। ওই চিকিৎসকদের আশঙ্কা, সরকারি বিধি-বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে যাঁদের সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে এইচ১এন১ (ওই মারণ রোগের ভাইরাস) পজিটিভ রোগী থেকে গেলে তা রোগ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, ওই রোগীর থেকে সংক্রমণ অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ষোলো আনা।
কী সেই সরকারি বিধি, যার জন্য বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ?
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের নিয়ম অনুযায়ী সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষা করতে হলে উপসর্গ দেখে রোগীকে আগে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সেই সব উপসর্গকেও চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ‘এ’, ‘বি১‘, ‘বি২’ এবং ‘সি’। ‘এ’-র ক্ষেত্রে রোগীকে ভর্তি করা বা থুতু পরীক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ উপসর্গ দেখে সংক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ায় ওই সব রোগীকে আর ভর্তি করার প্রশ্নই নেই বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের অভিমত।
‘সি’-র ক্ষেত্রে উপসর্গ এমনই যে, রোগীকে ভর্তি করা বাধ্যতামূলক। রোগীর উপসর্গ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, তাঁর সোয়াইন ফ্লু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভর্তি করে নিয়ে থুতুর নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিয়েই চিকিৎসা শুরু করে না-দিলে রোগীর প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে যায়।
সর্দি-কাশির পাশাপাশি কোনও রোগীর হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, লিভার ইত্যাদির কোনও রোগ থাকলে, রোগী ডায়াবেটিক হলে কিংবা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খেলে তাঁদের ক্ষেত্রে কম মাত্রার সংক্রমণও জটিল আকার নিতে পারে। গর্ভবতী, শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রেও সামান্য উপসর্গ থাকলেই ভর্তি করে নেওয়ার কথা বলছে স্বাস্থ্য দফতর। এই উপসর্গকে বলা হচ্ছে ‘বি২’। ‘সি’-র মতোই গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়ে এই সব উপসর্গের রোগীদেরও ভর্তি করে নিতে বলেছে স্বাস্থ্য ভবন।
কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে ‘বি১’ নিয়ে। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ‘বি১’ উপসর্গযুক্ত রোগীকে ভর্তি করা বা নমুনা পরীক্ষা করার কথা নয়। এই বর্গের সংক্রমণের উপসর্গ কী? জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা-ব্যথা। চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশেরই আপত্তি এই জায়গাতেই। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, এই মুহূর্তে যিনি ‘বি১’ পর্যায়ে রয়েছেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনিই যে ‘সি’ পর্যায়ে চলে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে, এটা কি ধরে নেওয়া চলে? সংশ্লিষ্ট রোগী হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে যদি দেখা যায় যে, তাঁর থুতুর নমুনায় এইচ১এন১ ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার দায় কে নেবে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।
ওই চিকিৎসকেরা বলছেন, কাকে ভর্তি করা দরকার আর কাকে নয়, সেই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী একমাত্র সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকই। কোনও বাঁধাধরা নিয়ম এ ক্ষেত্রে শেষ কথা হতে পারে না। ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বি১ এবং বি২ উপসর্গের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। বি২-র ক্ষেত্রে শুধু যোগ হয় পুরনো কিছু অসুস্থতা। ডাক্তার রোগীকে ভাল ভাবে পরীক্ষা করে আঁচ পেতে পারেন, কার সোয়াইন ফ্লু হয়েছে আর কার নয়। তার ভিত্তিতেই রোগী ভর্তি এবং নমুনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। নিয়মের গেরোয় চিকিৎসাকে বাঁধলে সমস্যা হতে পারে।”
একই কথা বলেছেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও। এসএসকেএমের এক চিকিৎসকের কথায়, “নিয়ম দিয়ে হাত-পা বেঁধে রাখলে আখেরে ক্ষতি রোগীদেরই। সোয়াইন ফ্লু-র এমন বাড়বাড়ন্তের সময়ে নিয়মকানুনের ঊর্ধ্বে উঠে শুধু রোগী-স্বার্থেই কাজ করা উচিত।” পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীরও বক্তব্য, প্রশাসনিক গাইডলাইন বা নির্দেশিকা ধরে আর যা-ই হোক, চিকিৎসা হয় না। তিনি বলেন, “রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা আরও ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। নিজের রোগ সম্পর্কে জানার অধিকার আছে সাধারণ মানুষের।” তিনি জানান, সব ক্ষেত্রে রোগী ভর্তি করেই যে পরীক্ষা করতে হবে, তার কোনও মানে নেই। রোগ নির্ণয় করাতে গেলেই ভর্তি হতে হবে, এই আতঙ্কেও অনেকে ডাক্তারদের কাছে যাচ্ছেন না। সোয়াইন ফ্লু-র স্পষ্ট উপসর্গ নিয়ে চার পাশে ঘুরে বেড়ানো লোকজনই রোগটা বেশি ছড়াচ্ছেন। প্রশাসনকে সেটা মাথায় রাখতে হবে।
উপসর্গের ভিত্তিতে এই ভাগাভাগিকে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে কেন?
স্বাস্থ্যকর্তাদের যুক্তি, জনস্বাস্থ্যের তথ্যপঞ্জি যথাযথ রাখার জন্য এটা খুবই জরুরি। শুধু রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর নয়, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-ও এ ভাবেই ভাগ করেছে উপসর্গগুলিকে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী শুক্রবার জানান, বাতাসে সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। জ্বর ও সর্দিকাশিতে ভোগা অনেকের শরীরেই সেই ভাইরাস সাময়িক ভাবে ঢুকে পড়তে পারে। তার মানেই যে তাঁরা সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত, তা বলা যায় না। সোয়াইন ফ্লু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আরও কিছু মাপকাঠি থাকে। যথেচ্ছ পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলে ভুল তথ্যগুলি সামনে আসার ভয় থেকে যায়। এতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায় এক ধাক্কায়। কিন্তু সেই তুলনায় মৃত্যুর হারটা কম থাকে। ফলে বিশেষ একটি রোগে মৃত্যুহার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরির ভয় থাকে।
বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথায়, “কিছু বেসরকারি হাসপাতালে বি১ পর্যায়ের উপসর্গযুক্ত রোগীদের তো পরীক্ষা হচ্ছেই। এমনকী যাঁদের উপসর্গ ‘এ’ পর্যায়ভুক্ত, তাঁদেরও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এটা আমরা বরদাস্ত করতে পারি না। সরকারি নির্দেশিকা না-মেনে শুধু হাসপাতালের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে এমন কোনও পদক্ষেপ করা হলে সরকার সেটা মানবে না।”
স্বাস্থ্য দফতর তিনটি বেসরকারি হাসপাতালকে সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। তিনটির বিরুদ্ধেই কোনও না কোনও অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা এ দিন ওই তিন হাসপাতালকে নিয়ে বৈঠকে নিয়ম মানার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দেন। তাদের মধ্যে একটি হাসপাতালকে নিয়ম না-মেনে নমুনা পরীক্ষা এবং রোগীদের তথ্যপঞ্জি মজুত না-রাখার অভিযোগে বৃহস্পতিবার থেকেই পরীক্ষা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। শনিবার স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধিরা ফের ওই হাসপাতালে গিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখবেন। সন্তুষ্ট হলে তবেই ফের পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে জানান, এ দিনও সোয়াইন ফ্লুয়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। হুগলির বাসিন্দা ওই ব্যক্তি বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এই নিয়ে রাজ্যে সোয়াইন ফ্লুয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৪। এ দিন আরও ১৪ জনের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। সব মিলিয়ে আক্রান্ত ৪০৬ জন। প্রাক্তন সিপিএম মন্ত্রী গৌতম দেবের শ্বাসকষ্ট পুরোপুরি কমেনি। তবে তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল।