কোনও প্রাণীই সে যে জায়গায় বসবাস করে, তার ক্ষতি করে না। সেখানকার পরিবেশ বাঁচিয়ে চলে। কিন্তু আমরা আমাদের বাসস্থান, এই পৃথিবীর সঙ্গে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন জুড়ে দিয়েছি। পৃথিবী জুড়ে বর্জ্যের পাহাড় তৈরি করে ফেলেছি। অতিমারি পরবর্তী সময়ে কোভিড-বর্জ্য নিয়েও আশঙ্কায় দিন গুনছেন চিকিৎসকেরা। লকডাউনে পৃথিবীর রূপ-রং কতটা খোলতাই হয়েছিল, তার সাক্ষী প্রায় সকলেই। কিন্তু পৃথিবীর শরীর যে ভাঙতে বসেছে! এখনও যদি তাকে পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে এ বাসস্থানই ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। তাকে সুস্থ করে তুলতে দরকার সাসটেনেবল লিভিং।
সাসটেনেবল লিভিং কী?
যা সাসটেন করবে অর্থাৎ আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে, সেটাই সাসটেনেবল লিভিং। সহজ ভাবে পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন বলা যায়, যাতে পৃথিবীর ক্ষতি না হয়। খোয়াবগাঁয়ের রূপকার শিল্পী মৃণাল মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘ঝাড়গ্রামের এই লালবাজার অঞ্চলের মানুষদের জীবিকা বলতে ছিল গাছ কাটা, জমিতে মজুর খাটা। এখন ওদের হাতে রং-তুলি তুলে দিয়েছি। ওরা আঁকছে, গাছ কাটা বন্ধ হয়েছে। ওদের বোঝাতে হয়েছে, এই জঙ্গলই ওদের বাসস্থান, তা ধ্বংস করলে ওরা থাকবে না। ওরা বুঝেছে, আমাদেরও বুঝতে হবে। পরিবেশবান্ধব মানে শুধু মাটির বোতলে জল খাওয়া নয়। এটা একটা লাইফস্টাইল। জীবনযাপনের ধরন বদলাতে হবে। এতে অনেক লাভও আছে। এ গ্রামের মানুষদের অসুখবিসুখ নেই, করোনা তো দূরস্থান।’’ সূর্যোদয়ের সঙ্গে পুরো গ্রাম ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তার পর যে যাঁর কাজ সেরে সূর্যাস্তের কিছু পরেই খেয়েদেয়ে ঘুম। এঁরা মাটির হাঁড়িতে রান্না করে খান। নিজের জমিতে আনাজ উৎপন্ন হয়, তাই কীটনাশকও শরীরে প্রবেশ করে না। এর সবটুকু শহুরে জীবনে মেনে চলা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুপ্রেরণা নেওয়া যায়। কী ভাবে, সেটাই জেনে নেওয়া যাক। বিষাক্ত কৃত্রিম জিনিস দূরে সরিয়ে প্রাকৃতিক বিকল্প বেছে নেওয়া যায়।
প্লাস্টিকের পরিবর্তে
পরিবেশবিদরা মনে করছেন সকলের আগে বর্জনীয় প্লাস্টিক। পরিবর্তে কাপড়, পাট বা বাঁশের তৈরি জিনিস ব্যবহার জরুরি। জঙ্গলমহল উদ্যোগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ব্রত বেরা বললেন, ‘‘বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুরে অনেক কাজ হচ্ছে। বাঁকুড়ায় যেমন মাটির বাসন বানায় স্থানীয় মানুষরা। এই মাটির বাসনে রান্নাও করা যায়। মাটির থালা, বাটি, বোতল, গ্লাস থেকে শুরু করে প্রেশার কুকার পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায়।’’ অন্য দিকে জঙ্গলমহলের বহু বাসিন্দা তাঁদের আদি পেশা ফিরিয়ে এনেছেন। পাথরের থালা-বাটি তৈরি করছেন। পাহাড়ি পাথর জোগাড় করে কম্পাসের সাহায্যে মাপ নিয়ে তা কেটে-কুঁদে তৈরি হয় বিভিন্ন আকারের থালা, বাটি। কিছু মানুষ আবার ঘাসের দড়ি বানিয়ে তা থেকে তৈরি করছেন ব্যাগ। পাট বা কাপড়ের ব্যাগও রয়েছে। বাজারে প্লাস্টিক না নিয়ে জুট বা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে যেতে পারেন। এতে আপনিও পরিবেশের কথা ভাবলেন, আবার ওই মানুষগুলোর রুজির সংস্থান হল। চিকিৎসকদের মতে, প্লাস্টিকে করোনা-ভাইরাস বাঁচে প্রায় তিন দিন। সেখানে সুতির ব্যাগ বাড়ি এনে কেচে নিলেই বিপন্মুক্ত। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে জমা হয়েছে পৃথিবীর বুকে, সেই দূষণ কী ভাবে কমানো সম্ভব?
উপায় পুনর্ব্যবহার
যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য জমেছে, তা রিসাইকল করা ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করছেন কোয়ম্বত্তূরের এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক শান্তনু ভৌমিক। শান্তনু বললেন, ‘‘আমি ও আমার ছাত্ররা পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে প্লাস্টিক জোগাড় করি। তার পর তা সেগ্রিগেট ও পরিষ্কার করে সেই প্লাস্টিক দিয়েই রুফ টাইলস, পেভমেন্ট টাইলস তৈরি করছি। এর সুবিধে হল, একসঙ্গে পরিবেশকে দু’ভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়। প্লাস্টিক নদী, সমুদ্রকে দূষিত করবে না। ফলে জলজ প্রাণীরা বাঁচবে। দ্বিতীয়ত, প্লাস্টিক টাইলসে তাপমাত্রা কম থাকে। যে ঘরের ছাদে কংক্রিটের রুফ টাইলসে তাপমাত্রা ৬৩.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেখানে রিসাইকলড প্লাস্টিকের টাইলস বসানোয় তার তাপমাত্রা নেমে হচ্ছে ৩৫.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, প্রায় অর্ধেক। ফলে এসির উপরে নির্ভরতা কমছে।’’ এসি মেশিন থেকে যে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন নির্গত হয়, সেই গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণও কমবে। থার্মোকল রিসাইকল করে মোটর পার্টসও তৈরি করছেন তাঁরা। রিসাইকলড প্লাস্টিক দিয়ে আসবাবও তৈরি করছেন। শান্তনুর কথায়, ‘‘এতে গাছও বাঁচবে।’’ কলকাতায় কিছু ওয়ার্ডে বায়োডিগ্রেডেবল ও নন-বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য নেওয়ার জন্য দু’টি আলাদা পাত্র দেওয়া হচ্ছে। সেখানেও বর্জ্য আলাদা করা সম্ভব। কিন্তু তারও আগে প্রাত্যহিক বর্জ্যের পরিমাণ কতটা কমানো যায়, তা লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জ়িরো ওয়েস্ট
রোজ পরিবার-পিছু কতটা বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, সে দিকে খেয়াল রাখুন। রান্নাঘরের বর্জ্যের মধ্যে মূলত থাকে আনাজপাতির খোসা। সেটা কমপোস্ট করে গাছের সার তৈরি করা যায়। পুজোর ফুল বা মালাও ব্যবহার করা যায়। এমন ভাবে জিনিস বাছুন, যা থেকে কোনও ওয়েস্ট তৈরি হবে না। এই চিন্তা মাথায় রেখেই কলকাতার এক উদ্যোগপতি লতা ভাটিয়া ‘জ়িরো ওয়েস্ট বাজ়ার’ শুরু করেন। লতা বললেন, ‘‘রাস্তা জুড়ে এত বর্জ্যের স্তূপ আমাকে খুব ভাবাত। তাই প্রথমে আমি এমন ভাবে চলার চেষ্টা শুরু করলাম, যাতে ওয়েস্ট জ়িরো হয়। প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করলাম। কোথাও গেলে জলের বোতল, চামচ সঙ্গে রাখি। এর পরেই শুরু করি জ়িরো ওয়েস্ট বাজ়ার। বাম্বু টুথব্রাশ থেকে রিইউজ়েবল ন্যাপকিন, ডায়পার রাখতে শুরু করলাম। বুটিক থেকে ওয়েস্ট কাপড় সংগ্রহ করে ব্যাগ বানাই। রান্নাঘরের বর্জ্য কমপোস্ট করে সার হিসেবে ব্যবহার করি।’’ পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে গাছ লাগানোও জরুরি বলে মনে করেন।
বৃক্ষরোপণ
চারপাশে তাকালেই বুঝতে পারবেন গাছ না বাড়ি, কোনটা বেশি চোখে পড়ে। অথচ সেই পাড়ার বছর কুড়ি আগের ছবি দেখলে চমকে উঠতে হয়। গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে মহীরুহ-সমান বিল্ডিং। তাই বাড়ির আশপাশে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিতে পারেন। আমির খানের পানি ফাউন্ডেশন এক রুক্ষ ভূমিতে হাজারখানেক গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চলে পরিণত করেছে। এখন সেখানে কয়েকশো প্রজাতির পশুপাখির বাস। সে জায়গার তাপমাত্রাও কমেছে অনেকটা। উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাড়ায় গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়াই যায়। নিজের বাড়িতেও ফলাতে পারেন রোজকার আনাজপাতি, যাতে ক্ষতিকর কীটনাশক থাকবে না। ছোট ছোট পদক্ষেপে জীবনযাপনেও বদল আনতে পারেন।
যে পদক্ষেপ জরুরি
• দেশের বিভিন্ন রাজ্যে জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে গিয়েছে। বুঝে খরচ করুন জল। হেঁশেলের আনাজ, চাল ধোয়া জল গাছে দিতে পারেন। কাপড় কাচার জল দিয়ে ঘর মোছা যায়। রেনওয়াটার হারভেস্টিংও করা যায়।
• যাতায়াতের জন্য ই-বাইক বা সাইকেল ব্যবহার বাড়াতে পারেন। পেট্রোল-ডিজ়েলের দূষণ নেই।
• বেরোনোর সময়ে কাপড়ের ব্যাগ সঙ্গে রাখুন।
• অনেক রেস্তরাঁ মাটির পাত্রে বা কাগজের কৌটোয় খাবার ডেলিভারি করে। সেটা জেনেও অর্ডার দিতে পারেন।
• ৫০ মাইক্রনের কম ঘনত্বযুক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
• বাড়িতে অতিথি সমাগমে প্লাস্টিক বা থার্মোকলের পরিবর্তে কলাপাতা, শালপাতার থালার ব্যবস্থা রাখুন।
• রাস্তায় বেরোনোর সময়ে বাম্বু-স্পুন বা নিজের একটি চামচ ক্যারি করতে পারেন। স্ট্র ও প্লাস্টিকের চামচ রোজ কয়েক টন বর্জ্য তৈরি করে।
• স্যানিটারি ন্যাপকিনও প্রকৃতিতে মেশে না। তাই ইকোফ্রেন্ডলি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারেন। শিশুদের ডায়পারও একই ধরনের বর্জ্য তৈরি করে। কৃত্রিম ডায়পারের বদলে কাপড়ের ডায়পার ব্যবহার করুন।
প্রত্যেকে এগিয়ে এলে পৃথিবীর স্বাস্থ্য ফিরতে ও রূপ খুলতে বেশি সময় লাগবে না। তখন এই সুন্দর, সুস্থ পৃথিবীই হবে আমাদের আগামীর বাসস্থান।