প্রতীকী ছবি।
মা থাকেন অন্য রাজ্যে। কর্মসূত্রে বাবার সারা দিনই বাইরে কাটে। শহরের একটি বড় আবাসনের ফ্ল্যাটে থাকলেও বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিল না। তার উপরে করোনার জেরে বন্ধ স্কুল। বন্ধ বাইরে যাওয়াও। একা থাকতে থাকতে চেপে বসেছিল অবসাদ। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে এতটাই হাঁফ ধরে গিয়েছিল যে, শেষমেশ পঁচিশতলার ফ্ল্যাটের শৌচালয়ের জানলা দিয়ে নীচে ঝাঁপ দিয়েছিল সে। সম্প্রতি আনন্দপুর থানা এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে।
অন্য একটি ঘটনায় আবার পর্ণশ্রীতে একই সঙ্গে আত্মঘাতী হয়েছিলেন মা ও ছেলে। মায়ের মৃত্যু মানতে না-পেরে চার মাসের মাথায় বছর ১৪-র কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। কাজ হারিয়ে আর্থিক অনটনের চাপ নিতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন বছর ৬৩-র এক প্রৌঢ়ও।
করোনা পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাসে শহরের বুকে ঘটে গিয়েছে একের পর এক এমনই আত্মহত্যার ঘটনা। এক-এক দিনে ছ’-সাতটি করেও আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। পুলিশের তথ্য বলছে, এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। প্রতি বছরই শহরে আত্মহত্যার বহু ঘটনা ঘটে। তবে করোনা-পর্বে সেই সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ঋতু পরিবর্তনের জ্বর সতর্ক থাকুন অভিভাবকেরা
আরও পড়ুন: শীতকালে জলপান কমিয়ে দেবেন না
পুলিশ সূত্রের খবর, ২০১৯ সালে কলকাতা পুলিশ এলাকায় আত্মঘাতী হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জন। কিন্তু গত মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার পরেই আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে থাকে। পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়, ‘‘এ বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কলকাতা পুলিশ এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৫০টির মতো।’’
যদিও বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, করোনাই একমাত্র কারণ নয়। আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে আত্মহত্যার এই প্রবণতার পিছনে। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভারত এমনিতেই আত্মহত্যার নিরিখে পৃথিবীর এক নম্বরে রয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, এ দেশের ১৫-৩০ বছর বয়সিদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সব চেয়ে বেশি বলে নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ (এনসিআরবি)-র রিপোর্টও জানাচ্ছে, ওই বছর ভারতে আত্মহত্যার মোট সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১২৩। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যাটাই ছিল ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫১৬। তবে চলতি বছরে সংখ্যাটা অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা।
মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল জানাচ্ছেন, অতিমারির এই পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বেই আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তার পিছনে কয়েকটি কারণও দেখানো হয়েছিল। যেমন, অনেকেই কাজ হারিয়ে রোজগারহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে তীব্র হতাশা চেপে ধরছে তাঁদের। আবার যারা কমবয়সি, সেই সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে বা বাইরে বেরোতে না পেরে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যেও এই প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে।
তবে যাঁরা আগে থেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন, লকডাউনে তাঁদের সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। হঠাৎ করে লকডাউনে সব বন্ধ। ফলে চিকিৎসকের পরামর্শ ঠিকমতো মেলেনি। ওষুধ পেতেও সমস্যা হয়েছে। অন্য দিকে, মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব জানাচ্ছেন, লকডাউন ওঠার পরে অনেকেই আসছেন তীব্র মানসিক উৎকণ্ঠার চিকিৎসা করাতে। সেই উদ্বেগ এতটাই যে, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তবে সব চেয়ে চিন্তার বিষয় হল, অনেকে নিজের মানসিক সমস্যা রয়েছে বুঝেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। যাঁরা আসছেন, তাঁরা অন্তত চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হওয়ার সুযোগটুকু নিজেকে দিচ্ছেন। যাঁরা আসছেন না, তাঁদের ঝুঁকিটাই বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে কলকাতা পুলিশের তরফে একটি বিশেষ পদক্ষেপের কথা ভাবা হয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর, স্কুল-কলেজগুলিতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বা কর্মশালার কথা ভাবছে তারা। এমনকি, শুধুমাত্র আত্মহত্যা রুখতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি হেল্পলাইন নম্বর চালুরও পরিকল্পনা রয়েছে। কেউ অসুবিধায় পড়লেই ফোন করে কাউন্সেলিংয়ের আবেদন জানাতে পারবেন সেখানে।