নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির স্কুল শুরু হল। ধাপে ধাপে শুরু হবে নীচের ক্লাসগুলিও। কিন্তু স্কুল খোলা নিয়ে অভিভাবকরা দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে অনলাইন ক্লাসেই বেশ স্বচ্ছন্দ ছিল এত দিন। অনেকে আবার স্কুল খোলায় খুশি।
ছাত্রছাত্রীদের বায়োলজিক্যাল ক্লক গত পৌনে দু’বছরে বদলে গিয়েছে। সুতরাং স্কুলের অভ্যেস ফিরে আসায় কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হবে। তবে স্কুলে ফেরার আনন্দও তো কম নয়। মডার্ন হাই স্কুলের ডিরেক্টর ও শিক্ষাবিদ দেবী করের কথায়, “দীর্ঘ দিন পরে স্কুলে ফিরে স্টুডেন্টরা খুশি। খুব আনন্দ করেই ক্লাস করছে। মাঝে যখন স্কুল খুলেছিল, তখন ওদের মধ্যে ভয় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এ বার ওরা বেশ হাসিখুশি। কারণ মাঝে অনেক মাসই ওরা রিল্যাক্সেশনের সময় পেয়েছে।” এ বার স্কুলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাই অনেক বিষয়ে নজর রাখতে হবে—
* এত দিন পরে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস করার আনন্দে নিরাপত্তার দিকটা ভুলে গেলে হবে না। মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, হাত স্যানিটাইজ় করার অভ্যেস ধরে রাখতে হবে স্কুলেও। দীর্ঘক্ষণ মাস্ক বা ফেসশিল্ড পরে থাকা নিয়ে কেউ মজা করতে পারে। কিন্তু নিজের সাবধানতা নিজের কাছে। বিশেষ করে গল্প করার সময় মুখ থেকে মাস্ক নামানো চলবেই না।
* আটটার অনলাইন ক্লাসে পৌনে আটটায় উঠে স্ক্রিন অন করলেই হত। কিন্তু স্কুল শুরুর পরে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেসও শুরু। শরীর বিদ্রোহ করতে পারে। দরকারে ঘুম থেকে উঠে একটু ওয়ার্মআপ করতে হবে ছাদে বা বাড়ির সামনের কোনও পার্কে। কারণ বাড়ি থেকে তৈরি হয়ে বেরিয়ে স্কুলে পৌঁছনোর ধকলও সওয়াতে হবে শরীরে।
* এত দিন নিয়মিত রাস্তায় না বেরোনোয় অধিকাংশ ছেলেমেয়ে ধুলো-ধোঁয়া-দূষণ থেকে দূরে থেকেছে। নিয়মিত বেরোনো শুরু হলে অ্যালার্জি বা সর্দিকাশির সম্ভাবনা প্রবল। যাদের শীতে হাঁপের সমস্যা হয়, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে তাদের সতর্ক থাকা দরকার।
* ক্লাসওয়ার্ক ও হোমওয়ার্ক নিয়মিত করার অভ্যেসে ফিরতে যেমন সময় লাগে, তেমন সময় দিন। এ সময়ে নজর দিন ওদের হাতের লেখায় আর বানানে। যোধপুর পার্ক বয়েস স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার বললেন, “উঁচু ক্লাসের তুলনায় এই সমস্যা ছোটদের ক্লাসে বেশি। অনলাইন ক্লাসে অ্যাক্টিভিটি শিট জমা দিতে হয়। তার থেকেই বুঝতে পারছি যে, বানান ও হাতের লেখা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছে। তবে বড়রা নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস। ওদের মধ্যে স্কুলে উপস্থিতির হারও বেশ ভাল। যে দিন প্র্যাক্টিকাল ক্লাস থাকে, সে দিন শতকরা ১০০ ভাগ উপস্থিতি থাকছে।”
* ক্লাসে তাড়াতাড়ি নোটস নেওয়ার অভ্যেসে ফিরতে হচ্ছে। স্ক্রিনশট নেওয়ার আর সুযোগ নেই। তাই অভিভাবককে নজর রাখতে হবে, সন্তানের লেখালিখি ও হোমওয়ার্কের দিকে। এত দিন পরীক্ষাও চলেছে বাড়িতে। নিয়মকানুন কিছুটা হলেও হয়তো শিথিল ছিল। এখন থেকে ক্লাসে শিক্ষকশিক্ষিকার পাহারায় পরীক্ষা দিতে হবে। এর জন্য বাড়িতে পরীক্ষা দেওয়ার অভ্যেস করতেই হবে।
* দীর্ঘ অনভ্যেসের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় তলানিতে। টিফিন এবং জল শেয়ার করার ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। পেন, পেনসিল, ইরেজ়ার শেয়ার করা গেলেও খাবার এখন ভাগ না করাই নিরাপদ। ‘‘টিফিন খাওয়ার সময়ে স্টুডেন্টদের মনিটর করা হচ্ছে, যাতে ওরা নিজের জায়গায় বসে আলাদা ভাবে খাবার খায়। তখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়, যােত ওদের মন খারাপ না হয়। কারণ এ সময়টা ওরা বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে টিফিন খেয়ে, খেলা করে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন করোনাবিধি মেনে চলতে হবে,’’ বললেন ঘোলা হাই স্কুলের (উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষিকা মৌসুমী পাল।
মনের লাগাম থাকুক হাতে
দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকের স্কুলের প্রতি অনীহা ও নানা মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন—
* মিশতে পারার সমস্যা। একা ক্লাস করে সে অভ্যস্ত। ফোনে বন্ধুর সঙ্গে মতান্তর হলে কল কেটে দিলেই ‘দ্য এন্ড’। কিন্তু স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে রোজ দেখা হবে। ফলে আগের মতোই ঝগড়াঝাঁটি হলে তা মিটিয়ে নিতে হবে। যাকে অপছন্দ, তাকেও মেনে নিতে হবে।
* ডিজিটাল আসক্তি কাটাতে হবে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, “বাচ্চারা মোবাইল ও ল্যাপটপের বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের ফাঁকে কেউ সিনেমা দেখছে, কেউ গেম খেলছে। এই ধরনের বিনোদন আস্তে-আস্তে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে এ রকম বিনোদনের সুযোগ নেই। স্কুলের রুটিনের সঙ্গে সন্তানকে অভ্যস্ত করান। পড়ার মাঝে ছাদ বা বাড়ির নীচ থেকে ঘুরে আসতে বলুন। কিন্তু ফোন, ল্যাপটপ দিয়ে বসিয়ে রাখবেন না। স্কুলে কী পাবে আর কী পাবে না, সেটা মাথায় রেখে অভ্যেস করান।” নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে সন্তানকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। না হলে স্কুল কামাই করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
* ভয় কাজ করতে পারে মনের মধ্যে। অনেকেই প্রিয়জন হারিয়েছে করোনায়। তা ছাড়া টিকাকরণ না হওয়ার ফলেও আতঙ্ক দেখা দিতে পারে। “ছোটদের সামনে কখনও ভয়, দুশ্চিন্তার কথা আলোচনা করবেন না। ‘স্কুল খোলার কী দরকার?’, ‘স্কুলে গেলে করোনা হবে না তো!’... এ ধরনের নেতিবাচক কথা বলবেন না সন্তানের সামনে। বরং সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে একটা নতুন স্কুলব্যাগ, ডায়েরি বা জলের বোতল কিনে দিন,” বললেন পায়েল। এতে সে-ও মনে-মনে প্রস্তুত হবে।
* টেনশন কাজ করতে পারে। হয়তো কোনও বাচ্চা স্কুলে বুলি হত, ক্লাসে পড়া পারত না বা কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ভীষণ ভয় পেত। তারা কিন্তু অনলাইন ক্লাসে বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। তাদের জন্য স্কুলচত্বরে পা রাখা বেশ উদ্বেগের। তাই আপনার সন্তান যদি স্কুল যাওয়ার সময়ে টেনশন করে, তার সঙ্গে কথা বলুন। ওর সমস্যা মেটাতে সাহায্য করুন।
* সমস্যা এখানেই শেষ নয়, আরও গভীরে তার শিকড়। শিক্ষিকা মৌসুমী পালের কথায় তার আঁচ পাওয়া গেল, “স্কুলছুটের সংখ্যা কিন্তু বাড়ছে। অনেক ছেলেই বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক অভিভাবক আবার টিকাকরণের আগে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ইতস্তত করছেন। স্কুলে এলেও ওরা দীর্ঘক্ষণ মাস্ক পরে হাঁপিয়ে উঠছে। তাই মাঝেমাঝে মাস্ক খুলে একটু শ্বাস নেওয়ার সুযোগও করে দিতে হচ্ছে। আর একটা সমস্যা বাথরুমের। নিয়মিত স্যানিটাইজ় করা বাথরুম দরকার ওদের জন্য।”
এই মুহূর্তটা আপনার সন্তানের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা অভ্যেস ভেঙে সে নতুন অভ্যেস তৈরি করেছে। এখন সেটা ভেঙে আবার পুরনো অভ্যেসে ফিরতে হবে। এ সময় ওর পাশে থাকুন যাতে ও হোঁচট খেলে ওকে ধরতে পারেন। প্রয়োজনে সন্তানের সঙ্গে বেশি সময় কাটান। সারা দিন কিন্তু আর পাবেন না ওদের সঙ্গ। জীবনের মূল স্রোতে সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এটুকু দায়ভার অভিভাবকেরই।
নবনীতা দত্ত
সুবর্ণ বসু