—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দৃশ্য ১: দিনকয়েক আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে অভিষিক্তার। সম্প্রতি ভিন-রাজ্যে কর্মরত হওয়ায় মন খুলে দু’টি কথা বলার লোকও নেই। এ সময়ে সমাজমাধ্যমই হয়েছে তাঁর মনের কথা বলার সঙ্গী। কখনও কখনও ভীষণ দুঃখের মুহূর্তের কথাও লিখে ফেলেন নিজের পোস্টে। তাতে নানা জনে নানা মত প্রকাশ করেন। এসেছে কটূক্তি, কুমন্তব্যের ঝড়ও!
দৃশ্য ২: দিন থেকে রাত হয়ে যায়, স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে পারেন না ঋভু। ইদানীং রোজই একটি করে দুঃখের গান বা কবিতার লাইন পোস্ট করছেন তিনি। দারুণ বিরহ যে রয়েছে সে পোস্টের নেপথ্যে, তা নয়। তবে চেনা-অচেনা মানুষের সহানুভূতিময় মন্তব্য পাওয়ার প্রলোভনই যেন তাঁকে দিয়ে এ কাজ করাচ্ছে।
অভিষিক্তা-ঋভুর ঘটনা থেকে প্রশ্ন ওঠে, প্রতিনিয়ত যে শত-সহস্র পোস্ট আমরা সমাজমাধ্যমে দেখি, সেগুলির সবই কি ১০০ শতাংশ সত্যি এবং একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ভাবনার প্রকাশ? অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর উত্তর ‘না’। এই প্রবণতার নাম হল— স্যাডফিশিং।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, স্যাডফিশিংয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নেটমাধ্যমে দুঃখের কথা ভাগ করে নেন অনেকে। এই স্বার্থ কখনও অন্যের সহানুভূতি, মনোযোগ বা লাইক-কমেন্ট-শেয়ার পাওয়া অবধি সীমিত থাকতে পারে। কখনও আবার অর্থ বা অন্য বাণিজ্যিক কারণেও স্যাডফিশিংকে ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। হতে পারে এটা কোনও মানসিক সমস্যার ইঙ্গিতও।
মনে পড়ে, ২০১৯-এ ব্রণর সমস্যা নিয়ে এক তারকার দুঃখের পোস্ট। পরে সেখানেই তিনি জানান যে, পোস্টটি ছিল একটি বিজ্ঞাপনের অংশ! এমন ঘটনার কথা লিখতে গিয়ে ‘স্যাডফিশিং’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রেবেকা রিড নামে এক সাংবাদিক। ‘ক্যাটফিশিং’-এর সঙ্গে মিল থাকলেও, এই প্রবণতা বেশ কিছুটা আলাদা।
কেন এমন পোস্ট
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের মতে, এর নেপথ্যে থাকতে পারে:
শুধু নেট দুনিয়ায়?
স্যাডফিশিংয়ের বিষয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা নীলশ্রী ভট্টাচার্য বলছেন, “যে কোনও সামাজিক স্তরেই এই প্রবণতা দেখা দেয়। সেটা পারিবারিক কোনও গেট টুগেদারের অনুষ্ঠানে, বন্ধুমহলে বা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সময়েও হতে পারে”। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে ব্যস্ততা এবং গ্যাজেট-নির্ভরতা। কমে যাচ্ছে মুখোমুখি বসে কথা বলার সময়-সুযোগ, সঙ্গী হচ্ছে একাকিত্ব। বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য ইন্টারনেটের উপরে নির্ভরশীল হচ্ছেন মানুষজন। এই সংক্রান্ত অ্যাপ, ডেটিং সাইটে বেশি ভরসা রাখছেন। ফলে বদলে যাচ্ছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। এই ছিদ্রপথেই স্যাডফিশিংয়ের প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।
ক্ষতি যেখানে
ঈশপের গল্পের সেই রাখাল বালককে মনে পড়ে? নেকড়ে আসছে বলে রোজই গ্রামবাসীকে অস্থির করে তুলত সে। কিন্তু যে দিন সত্যিই নেকড়ে এল, সে দিন রাখাল বালককে কেউ বাঁচাতে এল না।’ স্যাডফিশিংয়ের বিষয়টিও কিছুটা এমনই।
সমাজমাধ্যমে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করার ফলে, মানুষজন সহমর্মিতা দেখাচ্ছে, ‘পাশে থাকার’ বার্তা দিচ্ছে, এ কথা ভাবতেও ভাল লাগে। তবে যখন সত্যিই কেউ সহানুভূতি, সমবেদনামূলক মন্তব্য পাওয়ার আশায় এমন পোস্ট করতে থাকেন, তাতে কি ততটা গুরুত্ব দেন বাকিরা? অন্য দিকে, একটা পর্যায়ের পরে প্রশ্ন ওঠে, এমন ধরনের পোস্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও। আবার আন্তর্জালের আড়ালে যে নানা বিপদ লুকিয়ে থাকে, তা-ও সহজে অগ্রাহ্য করা যায় না। যেমন, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতারক জাল বিস্তার করতে পারে। সাধারণত তারা ভুয়ো প্রোফাইলের মাধ্যমেই এটা করে থাকে। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই স্যাডফিশিংয়ের প্রবণতা থাকলে, বাড়ির লোককে বিশেষ নজর দিতে হবে।
তবে উপায়?
দুঃখের সময়ে কাছের মানুষজনের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলাটাই শ্রেয়। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। কোনও পরিচিত যদি নিয়মিত এমন ধরনের পোস্ট করেন, তার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা প্রয়োজন।এমন ধরনের পোস্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে, মজা না করে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। যদি জনপ্রিয়তা বাড়ানো বা বিনোদনমূলক কারণে এমন পোস্টের প্রতি আসক্তি বাড়ে, তা হলে সেটা নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুঃখযাপন না করে নিজের কোনও গুণ, শখ বা ভাল লাগার বিষয়ও তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। জীবনের ভাল দিকগুলো বড় করে দেখতে হবে। তবে যদি দেখেন এই দুঃখযাপন থেকে বেরোতে পারছেন না, তা হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।