‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ দেখানো হবে স্কটিশ চার্চ কলেজে, দিকে দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল পোস্টার। মঙ্গলবার সকালে হঠাৎ বাতিল হল অনুষ্ঠান। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
সমকামীদের নিয়ে ছবি দেখানো যাবে না। কয়েক জন পড়ুয়ার আর্জিতে কলেজ কর্তৃপক্ষকে নাকি এমনই নির্দেশ দিয়েছে চার্চ। সে কারণে মঙ্গলবার প্রায় বিনা নোটিসেই বন্ধ হল ছবি প্রদর্শন ও আলোচনাসভা। এমনই অভিযোগ উঠেছে স্কটিশ চার্চ কলেজের বিরুদ্ধে। শহরের এমন ঐতিহ্যবাহী কলেজে এ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় বিস্ময় এবং ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নানা স্তরে। কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করছেন, বাতিল নয়, পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠান।
এক মাস ধরে চলছিল ছবি প্রদর্শনের আয়োজন। সমকামীদের নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রকার দেবলীনা মজুমদারের ছবি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ দেখানোর কথা ঠিক হয়। তার পর ছিল আলোচনাসভা। তাতে ছবির পরিচালক দেবলীনার সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা ছিল ‘সাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র দুই সদস্য সমাজকর্মী মীনাক্ষি সান্যাল এবং কোয়েল ঘোষের। স্কটিশ চার্চ কলেজের মনোবিদ্যা বিভাগ এবং ‘দ্য উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট সেল’-এর সঙ্গে এই আয়োজনে হাত মিলিয়েছিল ইতিহাস, দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগও। এমএল ভৌমিক অডিটোরিয়ামে দুপুর ১.৩০ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল অনুষ্ঠান। দিকে দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল পোস্টার। কিন্তু সকালে সুর বদলাল কলেজ। হঠাৎই ফোন এল, অনুষ্ঠান বাতিল। দেখানো যাবে না ছবি।
আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রমনি’-র পরিচালক দেবলীনা। তিনি বলেন, ‘‘দুপুরে ছবি দেখানোর কথা। হঠাৎ সকালে ফোন এল, সব বাতিল করতে হবে। এক জন শিক্ষিকা খবরটা দিতে ফোন করেছিলেন। তখনও তাঁর গলা কাঁপছে।’’ দেবলীনার অভিযোগ, মৌখিক ভাবে জানতে পারেন তিনি যে, কয়েক জন পড়ুয়া ‘চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া’-এ অভিযোগ জানান এই ছবি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে। কলেজে ‘এমন ধরনের’ ছবি দেখানো উচিত নয়, এর পর এমনই নির্দেশ আসে বলে অভিযোগ। তার পরেই উদ্যোক্তাদের তরফে মঙ্গলবারের অনুষ্ঠান বাতিলের কথা জানানো হয়। প্রসঙ্গত দেবলীনার এই ছবি নিয়ে আগেও বিতর্ক কম হয়নি। কিছু দিন আগেই ওড়িশায় এক চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবির প্রদর্শন বাতিল করার দাবিতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মঙ্গলবার দেবলীনার অভিযোগ, ‘‘এ ভাবে হঠাৎ কোনও অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া যায় নাকি! এত দিন ধরে সব ঠিক হয়ে রয়েছে। আজকের স্ক্রিনিংয়ের জন্য এক প্রযোজকের সঙ্গে মিটিংও বাতিল করতে হয়েছিল আমাকে।’’
স্কটিশ চার্চ কলেজের উদ্যোক্তাদের তরফে এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ প্রথমে গিয়েছিল ‘সাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র কাছে। লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কাজ করা এই সংগঠনের দুই সদস্য কোয়েল এবং মীনাক্ষি সেই মতো প্রস্তুত ছিলেন আলোচনাসভায় যোগ দেওয়ার জন্য। কলকাতার বুকে এমন ঐতিহ্যবাহী কলেজ যে হঠাৎ ‘কারও চাপের মুখে পড়ে’ এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা ভাবতে পারছেন না ওঁরা। কিন্তু কোয়েলেরও অভিযোগ, চাপের মুখে পড়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। আনন্দবাজার অনলাইকে তিনি বলেন, ‘‘এক মাস ধরে কথা চলছে। কোন ছবি দেখানো হবে, কবে হবে, সব কিছু আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানোর সময়ে তো চিঠি এসেছিল। সেই মেল এখনও আছে আমার কাছে। হঠাৎ সব বাতিল করে দিল যখন, তখন আর সে সবের কিছুই এল না। লিখিত ভাবে কিছু জানানোই হল না!’’ কলেজের এই আচরণে দেবলীনার মতো বিরক্ত কোয়েলও।
মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত ছিল স্কটিশ চার্চ কলেজ। এই পোস্টারও ছড়িয়ে গিয়েছিল দিকে দিকে। ছবি: সংগৃহীত।
স্কটিশ চার্চে মঙ্গলবার দেবলীনার ছবি দেখতে যাওয়ার কথা ছিল গায়ক-পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের। স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রাক্তনী তিনি। নিজের কলেজে এমন অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখে উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন। হঠাৎ সব বাতিল হয়েছে শুনে নিজের কলেজ নিয়ে খানিকটা অস্বস্তির সুর প্রাক্তনীর কণ্ঠে। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমারও ছবিটি দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। দেবলীনার এই ছবিটা দেখা হয়নি এখনও। নিজেরই কলেজে এমন ভাবে অনুষ্ঠান বাতিল হল শুনে খারাপ লাগছে। তবু এতটুকু আশা রাখি যে, ছবির বিষয়টির জন্য বাতিল হল না প্রদর্শন।’’
অনিন্দ্যর আশা যেমনই হোক, বাস্তব অন্য কথাই বলছে। ছবির বিষয়ই এত বিতর্কের কারণ। অভিযোগ, সমকাম নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা ও তা ঘিরে ছবি দেখানো কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ঠিক নয় বলেই মনে করেছেন পড়ুয়াদের একাংশ। তাই তাঁরা চার্চের দ্বারস্থ হন।
কলেজের অন্দরে বিষয়টি নিয়ে হতাশা দেখা দিয়েছে। এক জন জানান, চার্চ থেকে লিখিত কিছু না এলেও, আপাতত মৌখিক ভাবেই এই অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এত দিনের আয়োজন হঠাৎ ভেস্তে যাওয়ায় মন খারাপ বহু পড়ুয়া ও শিক্ষকের। তবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে ভয় এবং অস্বস্তি স্পষ্ট। কারও কারও হোয়াট্সঅ্যাপ স্টেটাসে এখনও অনুষ্ঠানের পোস্টার দেখা গেলেও বিরক্তি, ক্ষোভ কিংবা উচ্ছ্বাস কিছুই প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দ নন তাঁরা। স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষা মধুমঞ্জরী মণ্ডল আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কিছু ‘গ্যাপ’ দেখা দিয়েছিল, তাই পিছোতে হচ্ছে এই ছবির প্রদর্শন। আমাদের কলেজের দ্য উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট সেল মাঝেমধ্যেই এ ধরনের অনুষ্ঠান করে। আগেও হয়েছে। আবার হবে। কিছু ত্রুটির কারণে আজকের অনুষ্ঠান পিছতে হল। অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়নি।’’ তবে অধ্যক্ষা জানান, এর পরে কবে ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ দেখানো হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি।
এ দিকে, কলেজের এমন সিদ্ধান্তে অসম্মানিত বোধ করেছেন দেবলীনারা। সাফো-র সদস্যারাও ক্ষুদ্ধ। মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানের পোস্টারের উপর লাল কালিতে ‘ক্যানসেল্ড’ লিখে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ওঁরা।