Mental Health

বহু চেষ্টায় মিলল ঠিকানা, মনোরোগীর তকমা কাটিয়ে ১১ বছর পর মায়ের মুখ দেখলেন সতনাম

লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ছিলেন বছর দশেক। বাড়ির ঠিকানাই জানা যাচ্ছিল না। অবশেষে পঞ্জাবের গ্রামে ফিরলেন সতনাম সিংহ।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:১৮
Share:

পরিবারের সঙ্গে সতনাম সিংহ। নিজস্ব চিত্র।

দশ বছর কেটেছে মানসিক হাসপাতালে। ঠিক করে মনে পড়ে না কী ভাবে পঞ্জাবের গ্রাম থেকে চলে এলেন কলকাতায়। সেরে ওঠার পর যাওয়ার জায়গাও ছিল না। বাড়ি কোথায় মনেই পড়ছিল না যে। অবশেষে সেই সতনাম সিংহ বাড়ি ফিরলেন।

Advertisement

মায়ের মুখ যে আবার দেখতে পাবেন, তা ভেবেই গত কয়েক দিন ধরে উত্তেজনায় ভরে উঠছিল সতনামের মন। মাঝে যে কত বছর মনেই ছিল না মায়ের মুখটা। বাড়িতে কে কে আছেন, ঠিক করে মনে পড়ত না। নিজের বাড়ির ঠিকানাই মনে ছিল না। তাই তো সেরে ওঠার পরও বাড়ি পাঠানো যায়নি সতনামকে।

লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ছিলেন বছর দশেক। সেরে গিয়েছিলেন, কিন্তু যাওয়ার জায়গা ছিল না সতনামের। সেরে ওঠা মনোরোগীদের মূলস্রোতে ফেরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ‘প্রত্যয়’। বন্ডেল গেট এলাকায় তাদের বাড়িতেই গত কয়েক মাস থেকেছেন সতনাম। সেখানকার সদস্যদের উদ্যোগেই শুরু হয় সতনামের বাড়ির খোঁজ। নিয়মিত ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকদের দেখাশোনা করেন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। তিনি এক দিন সতনামকে নিয়ে যান রাসবিহারী অ্যাভিনিউ চত্বরের এক গুরুদ্বারে। যদি সেখানে গেলে কোনও পথ পাওয়া যায়, সে আশায়। আশাহত হতে হয়নি তাঁকে। সেখান থেকেই নতুন ভাবে শুরু হয় সতনামের ঠিকানার খোঁজ। একে একে জানা যায় তাঁর এলাকার গুরুদ্বারের নাম, গ্রামের নাম, বাড়ির ঠিকানা।

Advertisement

সরকারি দফতরে প্রথম পরিজনেদের সঙ্গে দেখা হল সতনামের। নিজস্ব চিত্র।

মাঝে কয়েকটি মাস কেটেছে বটে। তবে বৃহস্পতিবার অবশেষে মায়ের মুখ দেখতে পেয়ে খুব খুশি সতনাম। এক সময়ে মনেই ছিল না যে মা বেঁচে আছেন। মা নরেন্দর কৌরও আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন ছোট ছেলের মুখ দেখার। বৌমা রভিন্দর আর তাঁদের দুই পুত্রকে আগলে আগলে রাখতেন শুধু। বাড়ির খোঁজ পাওয়ার পর জানা যায়, গত ১১ বছর ধরে সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না সতনামের। বহু জায়গায় খোঁজ করেও কিছু করতে পারেননি পরিজনেরা।

সতনামের বাড়ি পঞ্জাবের অমৃতসর শহরের কাছে ছোট্ট এক গ্রামে। এলাকার নাম সিধওয়ান। ‘প্রত্যয়’-এর তরফে প্রজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায় জানান, এই গ্রামের নাম জানতেই অনেক দিন গিয়েছে। রাসবিহারীর সেই গুরুদ্বারের সদস্যেরা ধীরে ধীরে সতনামের ভাষা বুঝে নানা ভাবে চেষ্টা করে গ্রামের নামটি জানতে পারেন। তার পর ভাল ভাবে খোঁজ নেওয়া হয় স্থানীয় থানায়। অবশেষে বাড়ির খোঁজ মেলে। অভিজিৎ বলেন, ‘‘সতনামের স্মৃতি কিছুটা চলে গিয়েছিল। কে কে আছেন বাড়িতে, সবটা মনে পড়ছিল না। বাড়ির খোঁজ পাওয়ার পর দেখা গেল ভরা সংসার সতনামের। মা, স্ত্রী এবং দুই ছেলে আছে। এ বার সকলের সঙ্গে দেখা হল।’’ অভিজিৎ জানান, বাড়ির খবর পাওয়া গিয়েছে জানার পর থেকে বেশ আনন্দে ছিলেন সতনাম। আগে ততটাও কথা বলতেন না সব সময়ে। কিন্তু বাড়ির কথা জানতে পেরেই বার বার মায়ের খোঁজ নেন। নিজের স্ত্রীর ছবি দেখতে চান।

কলকাতা থেকে পঞ্জাব যেতেও অনেকটা সময় লাগে। তার মধ্যে আবার ট্রেন লেট। বৃহস্পতিবার সকালে পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু বাড়ি যেতে যেতে দুপুর গড়াল। তবে সেখানে যেতেই দারুণ আদর। সরকারি দফতরে প্রথমে পরিবারের সঙ্গে দেখা করানো হয় সতনামের। সেখানে মামার সঙ্গে নতুন করে আলাপ হওয়ার পর গ্রামে যাওয়া হয়। সেখানে সতনামকে নিয়ে শুরু হয় ব্যস্ততা। তবে কান্নাকাটি নয়। অতিরিক্ত হাসিও নয়। সে সবের জন্যও বুঝি সময় লাগে। যে মায়ের মুখ দেখবেন বলে উত্তেজিত ছিলেন পুত্র, তাঁকে অবশেষে দেখতে পেয়ে যেন খানিক হতবাক তিনি।

এ দিকে সতনামের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরে আনন্দিত মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী। তবে তিনি বলেন, ‘‘সতনাম প্রত্যয়ে এসে পৌঁছেছিলেন ২০২২-এর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। সতনামের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হল অক্টোবর মাসে। তার পরে সতনাম বাড়ি পৌঁছচ্ছেন ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বাড়ির খোঁজ পাওয়ার পরেও অপেক্ষার এই সময়টা কী ভাবে কমানো যায়, সেটা দেখাটা জরুরি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পরিবারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে কিন্তু তাঁদের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে না, সেটা এই ধরনের সদ্য সেরে ওঠা মনোরোগীদের উপর যে মানসিক চাপ তৈরি করে, সেটা নতুন করে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কাকে জোরাল করে তোলে। জীবন সহায়তা কেন্দ্রের এই প্রকল্পটা নতুন। কিন্তু তার জন্য নতুন করে কোনও নীতি প্রণয়ন করা হয়নি। যে নিয়মে অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলি চলে, সে ভাবেই জীবন সহায়তা কেন্দ্র চলছে। অথচ অন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলির থেকে জীবন সহায়তা কেন্দ্রের উদ্দেশ্য কিন্তু আলাদা। বিশেষ করে আন্তঃরাজ্য ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে দুটো রাজ্য সরকারের নিয়ম এবং প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণেও অনেকটা সময় লাগছে। সরকারের তরফ থেকে এই নীতি নির্ধারণের উদ্যোগগুলি জরুরি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement