কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কতটা সচেতন মানুষ? —প্রতীকী ছবি।
খবরের শিরোনামে এখন বার বার উঠে আসছে কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন কিংবা হেনস্থার কথা। দিনের মধ্যে আট-দশ ঘণ্টা অনেকেই কর্মক্ষেত্রে থাকেন। সেখানে যদি নির্যাতন ও বৈষম্য যোগ হয়, তবে যাপনের কাঠামোতে চিড় ধরে। যার ফল পেশাগত উদ্বেগ। তবে অনেকেই এখনও বুঝে উঠতে পারেন না, ঠিক কোন ঘটনাকে নির্যাতন বলবেন, কোনটি তার বাইরে। কখন প্রতিবাদ করতে হবে, কখন বলতে হবে, আর নয়। নারীদের কাছে এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে এবং কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা নির্যাতন ও হেনস্থার ঘটনা জানতে রাজ্য জুড়ে গণশুনানির আয়োজন করা হবে। তার জন্য তৈরি হয়েছে মঞ্চ।
পশ্চিমবঙ্গে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক যৌন নির্যাতন, হেনস্থা এবং বিভিন্ন পদ্ধতিগত ব্যর্থতা প্রসঙ্গে নির্যাতিতা, বিশেষজ্ঞ এবং অন্য অংশগ্রহণকারীদের দাবি তুলে ধরতে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, স্বাধীন সংগঠন এবং নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা একসঙ্গে উদ্যোগী হয়েছেন। এই গণশুনানি কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার সমস্যার মোকাবিলা-সহ উপযোগী সংস্কারের লক্ষ্যে নারী ও প্রান্তিক মানুষদের বয়ান শোনার জন্য একট উপযুক্ত পরিসর তৈরি করার চেষ্টা করবে।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষানবিশ তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার প্রেক্ষাপটেই মূলত এই শুনানির আয়োজন করা হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ঝুমা সেন এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপরে নির্যাতন ও হেনস্থার ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে আর জি করের ঘটনা সমাজের সব স্তরের মানুষকে এ বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ বার একজোট হওয়ার সময় এসেছে। এই গণশুনানির মাধ্যমে আমরা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক যৌন নির্যাতন ও হিংসার ঘটনা ঠিক কেন হচ্ছে, কী ধরনের হেনস্থার শিকার হচ্ছেন নারীরা, এই হিংসা ও নির্যাতনের পরে তাঁদের মনের উপর ঠিক কী প্রভাব পড়ছে— এ সব বিষয় নিয়ে গভীরে জানতে চাইছি। গণশুনানির আয়োজন আমরাই প্রথম করছি না। নানা দেশে বহু বার এই ধরনের গণশুনানির শেষে যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে দেশের আইন বদলেও (পলিসি চেঞ্জিং) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরাও সেই দিকেই এগোতে চাইছি।’’
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক যৌন নির্যাতন বিষয়ক গণশুনানি নিয়ে বিশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে দামিনী বসু , ঝুমা সেন ও অনুরাধা তলওয়ার-সহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত নারীরা। —নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি বহুজাতিক সংস্থার ‘কাজের চাপ’ সহ্য করতে না পেরে পুণের ২৬ বছরের তরুণী অ্যানা সেবাস্টিয়ানের মৃত্যু ঘিরে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। সমাজকর্মী অনুরাধা তলওয়ার বলেন, ‘‘কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের অনেক বেশি নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। বিয়ে, পরিবার, সন্তান সামলেও তাঁরা একজন পুরুষের মতোই সমান দক্ষতার সঙ্গে সংস্থার উন্নতিতে সাহায্য করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন ওঠে। তাই মেয়েদের উপর মানসিক চাপটাও কিন্তু বেশি পড়ে। সব মহিলাকেই কর্মক্ষেত্রে এমন মানসিক হেনস্থা কিংবা নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আর জি করের ঘটনায় যে সংখ্যক মহিলা রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছিলেন, সেই সংখ্যার সঙ্গে কিন্তু এই সব ঘটনার বিরুদ্ধে যে সংখ্যক অভিযোগ থানায় জমা পড়ে, তার কোথাও কোনও মিল নেই। যা আমাদের আরও বেশি চিন্তিত করছে। আর সে কারণেই ৯ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বরের মধ্যে এই শুনানির আয়োজন করা হয়েছে রাজ্যের পাঁচটি জায়গায়।’’
নারী, কুইয়র এবং প্রান্তিকায়িত মানুষদের কর্মক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেই বিষয় মুখ খুলেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও। সাংবাদিক সম্মেলনে অভিনেত্রী দামিনী বসু বলেন, ‘‘আমি এমন একটি পেশার সঙ্গে যুক্ত, যেখানে কেবল আমাদের লাইনের মেয়েছেলেই বলা হয়। কর্মক্ষেত্রে কোথায় সীমা টানতে হবে সেটা আমরা অনেকেই জানি না। সেট থেকে, প্রডাকশন থেকে, কফি হাউজ় থেকে কখন কার শোয়ার ঘরে কে ডেকে নিচ্ছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা বুঝতে পারি না কোনটা আমাদের কাজের পরিধির মধ্যে পড়ে আর কোনটা পড়ে না। ভাল স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শের পার্থক্যটা আমরা কাজ করতে গিয়ে কোথাও যেন গুলিয়ে ফেলি। নারী হিসাবে এই সব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা কিন্তু রাখতে হবে আমাদের।’’
এই শুনানিতে অংশগ্রহণের জন্য নির্যাতিতারা তাঁদের বক্তব্য গোপনে মেল করে, হোয়াট্সঅ্যাপের মাধ্যমে, কিংবা শুনানি কেন্দ্রে গিয়ে সরাসরি জানাতে পারেন। অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় গোপন রাখার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গণশুনানি সফল করতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আমলা, নারী-রূপান্তরকামী-কুইয়র অধিকার বিষয়ক কর্মী, মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষ ভাবে দক্ষ মানুষদের অধিকার কর্মী-সহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটির সামনে নির্যাতিতদের বক্তব্যগুলি রিপোর্ট আকারে জমা দেওয়া হবে।