সোনার ফসল

রাসায়নিক নয়, বরং জৈব সার, নিরাপদ কীটনাশক ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি প্রয়োগে সফল অর্গ্যানিক কিন্তু বাজারে অর্গ্যানিক আনাজপাতির দাম অনেক বেশি। এর কারণ বুঝতে গেলে অর্গ্যানিক চাষআবাদ হয় কী ভাবে, সেটা আগে বুঝতে হবে।

Advertisement

নবনীতা দত্ত ও রূম্পা দাস

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

ফসল তোলার কাজ চলছে

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে চাহিদাও। চাহিদাপূরণে জোগান বাড়াতে উৎপাদন হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে। ব্রয়লার মুরগি, কার্বাইডে পাকানো ফল, কীট নাশ করে ফলন বাড়াতে ক্ষতিকর পেস্টিসাইডসের বহুল ব্যবহার। ফলে খাবারের এই কৃত্রিমতায় পুষ্টিগুণ যাচ্ছে কমে। কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের আনাজপাতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে অসুখের কারণ। তবে উপায়ও আছে। অর্গ্যানিক। কিন্তু বাজারে অর্গ্যানিক আনাজপাতির দাম অনেক বেশি। এর কারণ বুঝতে গেলে অর্গ্যানিক চাষআবাদ হয় কী ভাবে, সেটা আগে বুঝতে হবে।

Advertisement

অর্গ্যানিক কী?

Advertisement

কোনও রকম কৃত্রিম ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে জৈব পন্থা অবলম্বন করে চাষবাস, ফলনই হল অর্গ্যানিক। রোজকার আনাজপাতি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ থেকে শুরু করে পোশাক, ব্যাগ... সবই হতে পারে অর্গ্যানিক। সবচেয়ে বেশি চাহিদা অর্গ্যানিক উপায়ে চাষ করা ফল, আনাজ, হার্ব, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, মধু ইত্যাদির।

অর্গ্যানিক ফার্মিং

কোনও রাসায়নিক ব্যবহার চলবে না। ফলে সার বানাতে হবে প্রাকৃতিক উপায়ে। অর্গ্যানিক ফার্মিংয়ের ভিত কিন্তু সারের উপরেই। ফার্মের পশু-পাখির বিষ্ঠা শুকিয়ে তা দিয়েই মূলত তৈরি হয় জৈব সার। এ ছাড়াও কচুরিপানা খুব ভাল সারের কাজ করে। তাই গাছের গোড়ায় কচুরিপানাও দেওয়া হয়ে থাকে। মাটি ছাড়া শুধু কচুরিপানা জমিয়েও তাতে করে ফেলা যায় পেঁপে গাছ।

মাটির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয় কেঁচোকেও। গাছের গোড়ায় যাতে অক্সিজেন পৌঁছয়, তার জন্য খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে দেওয়াই দস্তুর। কিন্তু কেঁচো নিজেই এই কাজটা করে দেয়।

গাছে পোকা লাগলেও নষ্ট হয় আনাজপাতি। অর্গ্যানিকে কিন্তু পেস্টিসাইড চলবে না। তাই ব্যবহার করা হয় নিম অয়েল। গোমূত্রও ব্যবহার করা হয় কীটনাশক হিসেবে। ফলে পোকাও ধ্বংস হয়, আবার ক্ষতিও বিশেষ হয় না।

আনাজপাতি: একই জমিতে বছরে দু’বার, তিন বার ভিন্ন ফসল চাষ করা হয়। ধান তোলা হয়ে গেলে সেই জমিতেই চাষ হয় সরষে। আবার সরষে তোলার পরে ও ধান গাছ লাগানোর আগে করা হয় তিল চাষ। বাঁধাকপি, ফুলকপি চাষের ক্ষেত্রে জায়গা বেশি লাগে। কারণ প্রত্যেকটি চারা বা বীজের মাঝে ব্যবধান হবে এক হাত। আবার মুলোর সঙ্গে চাষ করা হয় লাল নটে শাক। মাটিতে চাষের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের জোগান বাড়ে।

আবার শীতের ঠান্ডায় পটোলের ফুল মরে যায়। গ্রীষ্মের রোদেই ফলন ভাল হয়। তাই বলে শীত এলে পটোল গাছ কেটে ফেলা হয় না। একটি পটোল গাছেই বছরের পর বছর ফলন হয়। কুমড়ো, পেঁপে, লাউ, বেগুনের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে হবে আনাজ বড় হওয়া পর্যন্ত।

হার্ব ও শাক: নটে, লাল নটে, কুলেখাড়া, ব্রাহ্মী, গুলঞ্চ, কালমেঘ, ধনে, পুদিনাও চাষ করা যেতে পারে। একসঙ্গে একাধিক হার্ব চাষ করা হয় সারি হিসেবে। এতে হার্ব তুলতে সুবিধে হয়। ব্রাহ্মী, কুলেখাড়া চাষ করা যায় জলেই। প্রথমে ছোট পাত্রে এবং পরে গাছ বড় হলে তা তুলে বড় পাত্রে রাখা হয়। এই গাছ থেকে তৈরি করা হয় নানা ভেষজ।

মাছ: পুকুরেই চাষ করা হয় তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, কই ইত্যাদি মাছ। পানাও ছড়িয়ে থাকে পুকুরের উপরে যাতে তারা খাবার পায়। অন্য দিকে আলাদা পুকুরে চাষ করা হয় চিংড়ির। জিওল মাছ বা বড় মাছ ধরা হয় বেড় জালে। অন্য দিকে চিংড়ি ধরতে ব্যবহার করা হয় বাঁশ দিয়ে তৈরি এক ধরনের জাল।

অ্যানিমাল হাজ়ব্যান্ড্রি ও পোলট্রি: কোয়েল, মুরগি থেকে শুরু করে গরু প্রতিপালনও করা যায় এখানে। মুরগি দু’টি ভাগে প্রতিপালন করা হয়। একটি ডিমের জন্য, অন্যটি মাংসের জন্য। কোয়েলের ক্ষেত্রেও তাই। অর্গ্যানিক দুধের চাহিদা তো রয়েইছে। আবার গরুর দুধ থেকে ঘি, মাখন যেমন তৈরি করা যায়, তেমনই গোবর ব্যবহার করা হয় জৈব সার তৈরি করতে এবং গোমূত্র কীটনাশক হিসেবে।

ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট

অর্গ্যানিক চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বর্জ্যর ব্যবহার। জৈব বর্জ্য হলে তা সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যায়। ফলে তা দিয়ে সার তৈরিও সহজ। কিন্তু শহুরে বর্জ্যের অনেকটাই প্লাস্টিক, সে ক্ষেত্রে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট জরুরি।

• এমন অনেক সংস্থা আছে, যারা প্রত্যেক দিন বর্জ্য সংগ্রহ করে। তার পরে তা থেকে কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক বর্জ্য পৃথক করা হয়। এই ওয়েস্ট সেগ্রেগেশন কিন্তু সবচেয়ে জরুরি। প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য আলাদা করে তা হস্তশিল্পের কাজে লাগানো হয়। অন্য দিকে কিচেন ওয়েস্ট অর্থাৎ আনাজপাতির খোসা, মাংসের ছাঁট ইত্যাদি পচনশীল বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস এবং সার তৈরি করা হয়। বায়োগ্যাস কাজে লাগানো হয় জেনারেটর চালানোর কাজে। সার

চলে যায় বিভিন্ন অর্গ্যানিক ফার্মে।

• পূর্ব কলকাতার ওয়েটল্যান্ডসে এই বর্জ্য ডিসপোজ়াল হয় ঠিকই। কিন্তু সে জায়গাও এখন কম পড়ছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের পাত্রে চাষ শুরু করা হয়েছে, যাতে তা রিসাইকল করা যায়।

অর্গ্যানিক পাবেন কোথায়?

বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা অনলাইন বাজারে অর্গ্যানিকের কাউন্টার আলাদাই থাকে। সেখান থেকে কিনতে পারেন। আবার সরাসরি অর্গ্যানিক ফার্মগুলিতেও যোগাযোগ করতে পারেন।

দাম বেশি কেন?

যেহেতু ফল পাকাতে বা ফলন বাড়াতে কোনও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না, তাই ফলন সীমিত। একটা ফল পাকতে যদি কুড়ি দিন সময় লাগে, ততটাই অপেক্ষা করা হয় অর্গ্যানিকে। অন্য দিকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে পাঁচ দিনেই হয়তো রাসায়নিক দিয়ে ফল পাকানো যায়। আবার পাঁচটার জায়গায় দশটা আনাজ বেশি ফলানো যায়। অর্গ্যানিক ফার্মিংয়ে ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয় না বলে পোকার কারণে ফসল নষ্ট হয়। তাই পরিমাণে উৎপাদন কম হয়। সেই জন্যই অর্গ্যানিকের দাম বেশি। তবে পরিকল্পিত ভাবে বর্জ্য ব্যবহার করে, জায়গার ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন বাড়ানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে।

বাড়িতেই অর্গ্যানিক

• অর্গ্যানিক চাষের জন্য দু’টি বিষয় মাথায় রাখা দরকার— স্বল্প জায়গা ও জলের ব্যবহার। বড় ড্রামের গায়ে সমান ব্যবধানে চৌকো করে চিরে নিন। প্রত্যেকটি চেরা জায়গায় একটি করে চারা লাগান। একটি ড্রামেই জন্মাবে একাধিক গাছ।

• ভার্টিকাল গার্ডেনিংও করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনেকটা জায়গা না পেলেও দেওয়ালের গা ধরে বা উল্লম্ব ভাবে একের পর এক ট্রে বা টবে চাষ করতে পারেন থানকুনি, ধনেপাতা, পুদিনা পাতার।

• লেয়ার গার্ডেনিংয়ে শাক, আনাজপাতির চাষও করা যায়। ভার্টিকাল গার্ডেনিংয়ে জায়গা খুব বেশি না পেলেও লেয়ারে তা পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে চওড়া ছড়ানো ট্রের মতো জায়গায় ধাপে ধাপে আনাজ বা শাক লাগাতে পারেন। যে গাছ লম্বায় বেশি বাড়বে তা সবচেয়ে উপরের ধাপে রাখুন।

• হাইড্রোপোনিক মেথডে একটি লম্বা পাইপের মধ্যে ফুটো করে করে গাছ পুঁতে দিতে পারেন। তবে বাড়িতেই তৈরি করতে হবে জৈব সার এবং কীটনাশক।

বাড়ির বর্জ্য থেকে সার তৈরি করে গাছের গোড়ায় দিতে পারেন। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট হবে। আবার আনাজও পাবেন।

ছবি: স্বপ্নিল সরকার

তথ্য ও ছবি: টোনা অরগ্যানিক ফার্ম

ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট: সেফ (SAFE)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement