‘ভালবাসারও তো কিছু অধ্যবসায় লাগে, যাতে সারাবছর তাকে লালন করা যায়।’
পয়লা বৈশাখকে যে প্রায় অনেকেই একলা বৈশাখ বলে ডাকেন, সে কারণেই কি না জানি না, এই দিনটির সঙ্গে আমার চিরকালই সখ্য খানিক বেশি। অর্থাৎ পয়লা জানুয়ারির থেকে কিঞ্চিৎ বেশি। ভবানীপুরের পুরনো দিনের বাড়ির পাতাবাহারের গাছ, উঠোন, খড়খড়ি, ঘুলঘুলি নিয়ে বড় হওয়া, মুখচোরা মেয়ে আমি। ভিতরে ভিতরে যেমন একলা চিরকাল ঠিক তেমনই এই দিনটিও। প্রচণ্ড দাবদাহ তাপের মধ্যেও কেমন চুপটি করে, একলা হয়ে এসে দাঁড়ায়, যেন সন্ধেবেলা পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তাকে । পাত্রপক্ষ আসবে বলে বাড়ির সকলের যত উৎসাহ থাকে, লাজুক মেয়েটিরও কি থাকে ততখানি? এও যেন তেমন, যত উৎসাহ আর উদ্দীপনা সবই ওই চৈত্র সেলের, সে ভারি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ভিড় সামলায়, আর রাস্তাময় মানুষের কোলাহলের মধ্যে দিয়ে ডাক পাঠায়, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। বিদায়ী চৈত্রের গায়ে লেগে থাকে হকারদের চিৎকার, বাড়ির সকলের জন্য কেনা নতুন জামার গন্ধ, তবে এ গন্ধ কিন্তু পুজোর জামার চেয়ে আলাদা। সুতির শাড়ি, সুতির ফতুয়া, সাদা পাজামা, কিংবা বাচ্চা মেয়েদের ফুল আঁকা টেপ ফ্রক। বড়জোর বেল্ট দেওয়া হাতকাটা সুতির ফ্রক। চৈত্র সেলের গায়ে তাই লেগে থাকে সুতি সুতি গন্ধ।
আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে শিখেছিলাম, কক্ষণও কিছু চাইতে নেই। আর তাই মায়ের হাত ধরে চৈত্র সেলের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝুলতে থাকা জামাকাপড়ের দিকে তাকালেও, চাইতে পারতাম না কিছুতেই। একবার মনে পড়ে, তখন সদ্য চুড়িদার পরার শখ, একটা দোকানে ঝুলতে থাকা ছাইরঙা একখানা চুড়িদার দেখে বড় পছন্দ হয়েছে। কিন্তু চাওয়া যে যাবে না, সে তো আমি জানিই। হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে মা সেইটেই কিনে দিলেন আমায়, আমার খুশি খুশি মুখ দেখে মা বুঝতে পেরে আমাকে বললেন “দেখো, তুমি যেহেতু চাওনি, এই জামাটা তুমি পেলে, কিন্তু যদি তুমি চাইতে, দেখতে এই জামাটা অন্য কারও হত।” সেই চৈত্রের শেষদিকে, কত বয়স হবে আমার ? হয়ত ১৩ বা ১৪! বয়ঃসন্ধির সেই চৈত্রতেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম, জীবনে তার মানে কিছু চেয়ে ফেললে তা আর থাকবে না আমার জন্য। তাই চাওয়া যাবে না কিচ্ছু। না পোশাক, না মানুষ। এই বিশ্বাস নিয়েই কত চৈত্র আর কত বৈশাখ যে কাটালাম আমি। আজকাল যখন দেখি, চারপাশে কেবল চাওয়া নয় খানিক ছিনিয়ে নেওয়ার উৎসব, তখন ভিতরে ভিতরে আরও একলা হয়ে যাই। আর আরও বেশি করে ছোটবেলার সুতির সুবাস ছড়ানো সেই পয়লা বৈশাখকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ফিরে যেতে সেই ছোট্টবেলায়, যখন বিশ্বাস করতাম, এইদিন যা যা করব আমি, সারা বছর ঠিক তাই তাই করতে পারব। আর তাই একটু বই পড়া, একটু হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়া, অল্প তালে তালে পা নাড়ানো, আবার দিদির সঙ্গে একটু খেলে নেওয়া, সবটা করে নিতে চাইতাম ওইদিন। হাজার মন কষাকষি হলেও ওই দিন অন্তত ঝগড়া করতাম না আমি আর দিদি। খুব সক্কালে বাসে উঠে বাবা মায়ের সঙ্গে লেক মার্কেটের কাছে এক মন্দিরে যেতাম আমরা, যার নাম ডাকাতে কালিবাড়ি। আমার পুজোর থেকে অনেক বেশি আগ্রহ ছিল ওই নামে। ফেরার পথে অবধারিতভাবে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গজা কিনে বাড়ি ফেরা হত। বেশ কিটকিটে মিষ্টি স্বাদের পয়লা বৈশাখ এসে হাজির হত দোরগোড়ায়, যা আবার সন্ধের দিকে গড়াত দোকানের হালখাতা বাবদ, কোল্ড ড্রিংক কিংবা মিষ্টির প্যাকেটের দিকে।
অনেকগুলি চৈত্র পেরলো, পেরলো অনেকগুলি বৈশাখ, সুতির টেপ ফ্রক বা হাতকাটা ফ্রক ছেড়ে, চুড়িদার পেরিয়ে পয়লা বৈশাখের দিন গায়ে উঠল শাড়ি। ততদিনে, আমার জীবনের সবচাইতে কাছের সঙ্গী হিসেবে এসে গিয়েছে কবিতা। দু’-চার লাইন লেখালিখির সুবাদে, বইপাড়ার আমন্ত্রণও জুটেছে। সারা বছর চুপচাপ একা একা কবিতা লিখে, পত্রপত্রিকায় পাঠাতে যে রকম ভয়, বই বেরোনোর সময় যে রকম ভয়, সেই সবটুকু ভয়কে হারিয়ে দিয়ে পয়লা বৈশাখে উঁকি দিতে শুরু করল এক বুক ঢিপ ঢিপ ভয়। কেননা ওই দিন বইপাড়ায় গেলে কাকে না দেখা যায় সেখানে। তবু ভয় আর লোভ মিশিয়েই যাওয়া শুরু হল পয়লা বৈশাখের বইপাড়ায়। কিছু প্রকাশনার দপ্তরে যে এক আধটা কপি আমার বইয়েরও আছে, এই বিস্ময়কে পিছনে ফেলে দিতে শুরু করল ওই অনেককে দেখতে পেয়ে যাওয়ার বিস্ময়। পয়লা বৈশাখের হাত ধরেই বেনিয়াটোলা লেনের আনন্দর দপ্তরে আমার প্রথম দেখা সমরেশ মজুমদার কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। উঠে গিয়ে কথা বলব, তেমন সাহস হয়নি। কিন্তু কোণার সোফায় বসে শুনেছি ওঁদের কথা বলা, বা সৌমিত্রবাবুর অনাবিল হেসে ওঠা, আর ওই দেখতে পাওয়াকেই ভেবেছি প্রাপ্তি। সমরেশ মজুমদারের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবেছি, ইনিই কি ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে লিখেছিলেন ‘অবিশ্বাস করে ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করে হারানো ভালো’? যা বদলে দিয়েছিল আমার সমস্ত জীবন। আবার কখনও বা শঙ্খবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে এক প্রকাশনা থেকে অন্য এক প্রকাশনার দপ্তরে যাওয়ার পথে। পয়লা বৈশাখের দিন যে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারলাম, এই আনন্দে ভরে থেকেছি সারাটা দিন। শূন্য দশকের কবি বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা নব্বইয়ের অগ্রজদের সঙ্গে যখন দল বেঁধে গিয়েছি, তখন অবশ্য মনে বল জুটেছে খানিক, সিঙারায় কামড় দিতে দিতে কিংবা ডাবের জল খেতে খেতে দিব্যি আড্ডা জমেছে আমাদের। হয়তো বা কোনও শাড়ি একটু বেশিবার দেখেছে কোনও পাঞ্জাবিকে, আবার হয়তো কোনও ফতুয়া আড় চোখে তাকিয়েছে কোনও ওড়নার দিকে। বইপাড়ার পয়লা বৈশাখের মজা এই, যে সেই সব তাকানো আগামী কোনও বইমেলার অনেক কবিতার বইয়ের ভিড়ে কোনও এক কবিতার পাতায় হারিয়েও যাবে ।
নীল ডেনিমের গা ঘেঁষে থাক
লাল আঁচলের সুতির রং
চৈত্র শেষের বৈশাখে আজ
প্রেমের হদিশ থাক বরং!
এখন হয়তো পয়লা বৈশাখ আর পাত্রপক্ষর অপেক্ষা করে না, সে ল্যাপটপের সামনে বসে নিজের কবিতার গোপন সাদা পাতা লুকিয়ে ফেলে, খুলে ফেলে আরও একটা পাতা, যাতে ফুটে উঠছে হয়তো কোনও অন্যরকম চৈত্রের চিত্রনাট্য। কিন্তু আজও তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এই দিন আমরা যা করব, সারা বছর ঠিক তেমনটাই কাটবে আমাদের। মানুষ যেমন বিশ্বাস করে ম্যাজিকে। আর তাই, এই অতিমারি, ভোট, গুলিবিদ্ধ লাশ, রাজনীতি দিয়ে ভাগ হয়ে যাওয়া বন্ধুবৃত্ত এই সবের মধ্যে দাঁড়িয়েও আমি চাইছি, চৈত্র সেলে যেন অনেকখানি ছাড়ে হাতে হাতে ঘোরে ভালবাসা, স্থৈর্য, শান্তি, সংযম আর প্রেম। আসলে ভালবাসারও তো কিছু অধ্যবসায় লাগে, যাতে সারাবছর তাকে লালন করা যায়। চকচকে ঝকঝকে সব পেয়েছির চৈত্রের গায়ে যেন আলতো করে এসে লাগে সুতি সুতি বৈশাখের হাওয়া… যে হাওয়ায় মেতে উঠবে বাকি বছরের সভ্যতা। যে সভ্যতার একটাই অস্ত্র— ভালবাসা।