প্রতীকী ছবি
বিশ্বে প্রতি আট জনের এক জন মানসিক রোগ এবং অবসাদের শিকার। এমনটাই জানা গিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে। এর এক বছরের মাথায়, অতিমারি-পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যা ২৬-২৮ শতাংশ বৃদ্ধির কথাও জানিয়েছিল ওই সংস্থা। বর্তমানে যে সেই সমস্যা আরও বেড়েছে— এ বিষয়ে নিশ্চিত মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদেরা।
মনের চিকিৎসার দু’টি দিক রয়েছে— ওষুধভিত্তিক ও থেরাপিভিত্তিক। বহু ক্ষেত্রেই ওষুধের পাশাপাশি থেরাপির পরামর্শও দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। বিভিন্ন থেরাপিরই একটি হল কবিতা থেরাপি। কবিতার দেশ ভারতে এর প্রচার প্রায় না থাকলেও আমেরিকা বা ইউরোপে এর প্রচার ও ব্যবহার যথেষ্ট।
মনোবিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে কবিতার প্রসারে ১৯২৮ সালে উদ্যোগী হয়েছিলেন আমেরিকায় এলি গ্রিফার। পেশায় ফার্মাসিস্ট ও আইনজীবী, নেশায় কবি এলির হাত ধরেই কবিতা থেরাপি নিয়ে ভাবনাচিন্তার শুরু। তাঁর মৃত্যুর পরে সঙ্গী দুই সাইকায়াট্রিস্ট গঠন করেন ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব পোয়েট্রি থেরাপি’ (এনএপিটি)। বিশ্বে এই কাজে আগ্রহীদের এনএপিটি-র সদস্যপদ এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরি।
যে কোনও নান্দনিক বিষয় মনকে ভাল রাখে। গান ও ছবি আঁকার মতো কবিতাও তৃপ্তি দিতে পারে। সেই তৃপ্তির কারণই হল মস্তিষ্কের ‘রিওয়ার্ড সার্কিট’ নামের অংশে ডোপামিন নামক নিউরোকেমিক্যালের ক্ষরণ। যা ফাংশনাল এমআরআই-এর মাধ্যমে মাপা যায়। সেই প্রক্রিয়াকেই কাজে লাগায় কবিতা থেরাপি।
২০১৯ সালে সদ্যোজাত শিশুদের মস্তিষ্কে কবিতার প্রভাব নিয়ে ফিনল্যান্ডে সমীক্ষা চলেছিল। ইইজি ব্যবহার করে তাদের ‘সারফেস ব্রেন অ্যাক্টিভিটি’ মেপে দেখা যায়, তাদের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের পরিবর্তনের থেকেও বেশি প্রভাব ফেলে ছড়ার পরিবর্তন। ২০১৬ সালে ব্রিটেনের ‘স্কুল অব সাইকোলজি ব্যাঙ্গর ইউনিভার্সিটি’ তাদের গবেষণায় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে জানায়, কবিতার প্রতি প্রেম না থাকলেও তার ছন্দ মস্তিষ্ককে কী ভাবে দ্রুত সতেজ করে।
মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন পানের মতে, ‘‘মনোরোগের চিকিৎসায় ওষুধ নিজস্ব কাজ করবে। কবিতা থেরাপি তার বিকল্প নয়। তবে কাউন্সেলিংয়ের মতো পদ্ধতিতে এর ব্যবহার করাই যায়। পারিবারিক হিংসার শিকার বা কেয়ার-গিভারদের জন্যেও এই থেরাপি কার্যকর।’’ মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের মতে, ‘‘থেরাপির মূল উদ্দেশ্য মানুষের চিন্তাকে নঞর্থক থেকে সদর্থক দিকে নিয়ে যাওয়া। সেই অর্থে কবিতাকে সে ভাবে ব্যবহার করলে তা ফলদায়ক হতেই পারে।’’
যদিও ভিন্ন মত পোষণ করে ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুজিত সরখেলের বক্তব্য, ‘‘এর কার্যকারিতা বুঝতে যে পরিমাণ গবেষণা প্রয়োজন, তা এখনও হয়নি। তাই এটিকে এখনই মানা যায় না।’’
ইতিহাসে প্রথম পোয়েট্রি-থেরাপিস্ট হিসেবে চিকিৎসক সোরানাসের নাম পাওয়া যায়। রোমান এই চিকিৎসক রোগীদের জন্য হাসির এবং দুঃখের কবিতা লিখতেন। ‘ফাদার অব আমেরিকান সাইকায়াট্রি’ বেঞ্জামিন রাশ সঙ্গীত, কবিতা লেখা এবং সাহিত্যকে চিকিৎসার আনুষঙ্গিক পর্ব হিসেবে মানতেন। বর্তমান চিকিৎসকদের মতে, সেই যুগে ওষুধ কম ছিল, তাই থেরাপি নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে।
আবৃত্তি শিল্পী শোভনসুন্দর বসুর মতে, ‘‘পোয়েট্রি থেরাপি বলতে বিদেশে যা দেখেছি, তা মূলত আবৃত্তি-থেরাপি। শিল্পীর কণ্ঠে শোনা কবিতা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে বেশি। যা মিউজ়িক থেরাপির থেকেও মস্তিষ্কের কিছু কেন্দ্রকে বেশি সক্রিয় করে। বলা হয়ে থাকে, কবিতাই শক্তিশালী শিল্প, যা সংবেদকে বেশি স্পর্শ করে।’’
বাচিক শিল্পী ঊর্মিমালা বসুর মতে, ‘‘শব্দের অভিঘাত অনেক জোরালো। সঙ্গীতেও মুক্তি আছে। তবে সেটা বোঝার কান চাই। শব্দের ক্ষেত্রে তা নয়। যেমন, কারও বিধ্বস্ত শরীর-মনে পরিচিত বা স্বল্পপরিচিত কেউ যদি তাঁকে বলেন, ‘এসো মা এসো’, সেটা দ্রুত মনে প্রলেপ দিয়ে ভাল লাগার জন্ম দেয়। এটাও মনে রাখতে হবে, ভাষাটা যেন সহজ এবং যাকে শোনানো হচ্ছে তাঁর বোধগম্য হয়। এই দিকগুলো ভেবে ব্যবহার করলে কবিতা থেরাপি হিসেবেও নিশ্চয়ই যথাযথ হবে।’’