২৩ মে বুদ্ধপূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। কথিত আছে, বৈশাখ মাসের এই দিনটিতে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনেই তিনি বোধিলাভ করেন। এবং ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ দিনেই তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্ব লাভের মধ্যে দিয়েই জগতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তিত হয়।
বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে উদ্যাপন হয়। বৌদ্ধেরা বুদ্ধের আরাধনা করেন। অষ্টশীল, সূত্ত পাঠ, সমবেত প্রার্থনা এবং নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এ দিন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বৌদ্ধমন্দির, গুম্ফাগুলিতে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসভার আয়োজনও করা হয়। সে সবের সাক্ষী থাকতে হলে বাড়ি বসে থাকলে চলবে না। বুদ্ধপূর্ণিমার উদ্যাপনে শামিল হতে কোন ঠিকানাগুলিতে না গেলে জীবনে একটা বড় অপ্রাপ্তি থেকে যাবে?
বুদ্ধগয়া: বৌদ্ধদের কাছে এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। পর্যটনকেন্দ্র হিসাবেও বিহারের বুদ্ধগয়া সমান জনপ্রিয়। এখানকার মূল আকর্ষণ হল মহাবোধি মন্দির। কথিত আছে, গৌতম বুদ্ধ এই স্থানেই বোধিলাভ করেছিলেন। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন এই মঠ সেজে ওঠে অন্য রূপে। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত থাকলে এক অন্য অভিজ্ঞতা হবে।
শোনা যায়, এই মহাবোধি মন্দির সম্রাট অশোকের আমলে তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী কালে গুপ্ত বংশের রাজারা এই মন্দির সংস্কার করান। পটনা থেকে মাত্র ৯৬ কিমি দূরে অবস্থিত বৌদ্ধদের মন্দির ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পেয়েছে।
মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রার্থনাকক্ষ। নির্বাণ লাভের পর কয়েক দিন যেখানে কাটিয়েছিলেন বুদ্ধ। এ ছাড়া রয়েছে চংক্রমণ। নির্বাণলাভের তৃতীয় সপ্তাহ যেখানে ছিলেন তিনি। চতুর্থ, ষষ্ঠ এবং ধ্যানপর্বের শেষ সপ্তাহ কেটেছিল যথাক্রমে রত্নগড় চৈত্য, পদ্মপুকুর ইত্যাদি স্থানে।
বুদ্ধের সাধনাস্থল ছাড়াও বুদ্ধগয়ায় রয়েছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। তাই মনাস্ট্রি, চিনা মন্দির, সুজাতা মন্দির, সুজাতা কুটির, বার্মিজ় বিহার মনাস্ট্রি এবং আরও অনেক কিছু।
ধর্মশালা, হিমাচল প্রদেশ: বুদ্ধপূর্ণিমার জমকালো উদ্যাপন হয় হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালার ‘সুগ্লাগখান’ বৌদ্ধ মঠেও। তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র এটি। ম্যাক্লিয়ডগঞ্জের কাছে অবস্থিত এই মঠ। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা এই স্থান যেন শান্তির পীঠস্থান। প্রতি বছর বুদ্ধপূর্ণিমার দিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা এখানে আসেন। এখানে দু’টি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। রয়েছে একটি সংগ্রহশালাও।
বুদ্ধপূর্ণিমার দিন রঙিন পতাকা এবং আলো দিয়ে সাজানো হয় গোটা মঠ। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের শোভাযাত্রা হয়। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করা হয়। এ দিন ধর্মশালায় ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনা করা হয়। এ ছাড়াও বৌদ্ধ দর্শন সংক্রান্ত বক্তৃতা এবং বৌদ্ধ শিল্প ও প্রত্নবস্তুর প্রদর্শনী-সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
লুম্বিনি, নেপাল: বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে নেপালে অবস্থিত লুম্বিনি মন্দির অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ লুম্বিনি গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। লুম্বিনিতে এলে মায়াদেবী মন্দিরে যেতেই হবে। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন এখানে অগণিত মানুষ আসেন। তিলধারণের জায়গা থাকে না।
সারা বছরই নানা আচার-অনুষ্ঠান চলতে থাকে। তবে বুদ্ধপূর্ণিমার সময় এখানে এলে অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ হবে। রঙিন পতাকা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় মন্দির চত্বর। নৈবেদ্য অর্পণ করা বুদ্ধের উদ্দেশে। এখানে সম্রাট অশোকের নির্মিত স্তম্ভ রয়েছে। সেটাও দেখে আসতে ভুলবেন না।
সারনাথ, বারাণসী: গৌতম বুদ্ধ এখানে প্রথম তাঁর ধর্মোপদেশ প্রচার শুরু করেন। সারনাথের বুদ্ধমন্দিরে বুদ্ধপূর্ণিমার উদ্যাপন হয় অন্য রকম ভাবে। এখানকার আধ্যাত্মিক পরিবেশ মনের অন্ধকার দূর করে। সারনাথের বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপনের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম হল ধামেক স্তূপ। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন এখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ধ্যান করেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। বুদ্ধের উপদেশ নিয়ে আলোচনা চলে।
সারনাথের বিভিন্ন মঠ এবং মন্দিরে এ দিন বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দর্শনার্থীরা সেই অনুষ্ঠানের অংশ হতে পারেন। আধ্যাত্মিক অনুশীলনেও যুক্ত হওয়ারও সুযোগ আছে।
কুশীনগর, উত্তরপ্রদেশ: গৌতম বুদ্ধের শেষ বিশ্রামস্থল হল উত্তরপ্রদেশের কুশীনগর। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন এই স্থান বুদ্ধ আরাধনায় মেতে ওঠে। ভোরবেলায় প্রার্থনা, মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বুদ্ধপূর্ণিমার আচার-অনুষ্ঠান। ফুল এবং মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয় মহাপরিনির্বাণস্থলের কাছাকাছি অবস্থিত ৪৯ ফুট লম্বা রামভর বৌদ্ধস্তূপ। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, মহাপরিনির্বাণের পর এখানেই বুদ্ধকে সমাধিস্থ করা হয়।
কুশীনগরে বৌদ্ধ মঠের অভাব নেই। বুদ্ধপূর্ণিমায় সেই স্থানগুলিতেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং আলোচনা চলে। কুশীনগরে বুদ্ধপূর্ণিমার উদ্যাপন চলে এক মাস ধরে। বুদ্ধপূর্ণিমার আবহে ঘুরে আসতেই পারেন কুশীনগর থেকে।
থিকসে মনাস্ট্রি, লেহ্: ভারতের অন্যতম প্রাচীন মনাস্ট্রি হল থিকসে। এই মনাস্ট্রির ঠিকানা সিন্ধু নদের অববাহিকার পার্বত্য অঞ্চল। এর স্থাপনকাল ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ। বৌদ্ধদেবী দোরযে চেনমোকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে এই মনাস্ট্রি।
লাদাখের সবচেয়ে বড় মনাস্ট্রি। পাথর কেটে বানানো এই স্থাপত্যের কারুকার্য এবং সৌন্দর্য মন ভরিয়ে তোলে। পাহাড় এবং সবুজে ঘেরা এই মনাস্ট্রিতে বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে বেড়িয়ে আসতে পারেন।
রুমটেক মনাস্ট্রি, গ্যাংটক: বুদ্ধপূর্ণিমার উদ্যাপনের সাক্ষী থাকতে কাছেপিঠে কোথাও যেতে চাইলে, সিকিমের গ্যাংটক শহরের এই বৌদ্ধগুম্ফায় চলে যেতে পারেন। সবুজ জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের কোলে এই গুম্ফা উৎসবের আবহে অন্য রকম ভাবে সেজে ওঠে। সিকিমে আগত পর্যটকদের কাছেও অন্যতম ঘোরার জায়গা এটি।
নিরিবিলি পরিবেশে এই গুম্ফা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের অন্যতম পীঠস্থান। কান পাতলে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর পাখির কূজন কানে আসবে। ছোট্ট চৌহদ্দির মধ্যে এই গুম্ফা নানা রঙে রঙিন। উৎসবের সময় এই রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মিন্ডলিং গুম্ফা, দেহরাদূন: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় দেহরাদূনের মিন্ডলিং গুম্ফা। উত্তরাখণ্ডের দেহরাদূন জেলার রাজাজি ন্যাশনাল পার্কের কাছাকাছি অবস্থিত এই মনাস্ট্রির প্রধান আকর্ষণ হল বুদ্ধের ১০৭ ফুট লম্বা মূর্তি।
বুদ্ধপূর্ণিমার দিনটি এখানেও বেশ জাঁকজমক করে উদ্যাপন হয়। গুম্ফা সাজানো হয় লাল, নীল, হলুদ পতাকা দিয়ে। গুম্ফার সন্ন্যাসীরা সকাল থেকেই নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তো আসেনই, এই সময় এখানে অনেক পর্যটকেরও সমাগম হয়।