মেডিক্যাল কলেজ হোক কিংবা জেলা হাসপাতাল, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সমস্ত রোগীর চিকিৎসা এখন কাগজে-কলমে ‘ফ্রি’ হয়ে গিয়েছে। যদিও সেই ‘নিখরচা’ চিকিৎসাতেও রোগীর পকেট থেকে কত টাকা কী-কী খাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে বির্তক রয়েছে বিভিন্ন মহলেই। কিন্তু তারই পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে, আর তা হল সরকারি পে ক্লিনিক।
প্রশ্ন উঠেছে, শয্যা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ যদি ফ্রি হয়, তবে পে ক্লিনিকের অস্তিত্ব থাকে কী ভাবে? রাজ্যে সরকারি পে ক্লিনিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল ক্যানসার পে ক্লিনিক। ক্যানসার চিকিৎসা ‘ফ্রি’ ঘোষণা করাকে যেখানে খোদ মুখ্যমন্ত্রীই তাঁর সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য বলে দাবি করছেন, সেখানে সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার রোগীদের জন্য পে ক্লিনিক চলছে কী ভাবে, তা নিয়ে রোগীদের পাশাপাশি প্রশ্ন তুলেছেন ক্যানসার চিকিৎসকেরাও।
মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন হাসপাতালে এ নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। বিক্ষোভ দেখাচ্ছে রোগীদের স্বার্থে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন। দিন কয়েক আগে স্বাস্থ্য ভবনে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের বৈঠকেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে অধ্যক্ষেরা জানতে চান, এই মুহূর্তে কেবিন এবং পিপিপি মডেলের কেন্দ্রে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া আর সবই যখন ফ্রি বলে নির্দেশ জারি হয়েছে, তখন পে ক্লিনিকগুলিও কি ঝাঁপ বন্ধ করবে? স্বাস্থ্যকর্তারা তাঁদের কোনও স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এ বিষয়ে এখনও মুখ্যমন্ত্রীর তরফে নির্দেশ আসেনি। তাই স্বাস্থ্যকর্তারাও আর এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই সামান্য রাজস্ব আদায়ের পথটুকু নষ্ট করতে চান না।
এনআরএসের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য কিংবা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপন লাহিড়ী দু’জনেই জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এগুলিও উঠে যাবে বলে শুনেছেন তাঁরা। কিন্তু এখনও সরকারি তরফে নিষেধা়জ্ঞা নেই। তাই তাঁদের হাসপাতালে ক্যানসারের পে ক্লিনিক চলছে।
আউটডোরের ভিড় এড়িয়ে তুলনায় নির্ঝঞ্ঝাটে ডাক্তার দেখানোর জন্যই সরকারি হাসপাতালে পে ক্লিনিক পরিষেবা চালু হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় এক দিকে রোগীদের ঝক্কি যেমন অনেক কম, তেমনই সরকারেরও আয়ের রাস্তা খুলে যায় বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ মনে করেন। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘নামী-দামি ডাক্তারদের চেম্বারে অনেক খরচ পড়ে। সরকারি হাসপাতালের পে ক্লিনিকে ১০০ টাকার বিনিময়ে সেই ডাক্তারদেরই দেখানো যায়। তাই সামর্থ্য থাকলেও বহু মানুষ ভিড় উপচে পড়া আউটডোরের চেয়ে পে ক্লিনিককেই বেছে নিয়েছেন। তাই এই ব্যবস্থা উঠে গেলে উপকারের চেয়ে অপকারই হবে বেশি।’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি অনুযায়ী, ২০২০-র মধ্যে প্রতি পরিবারে অন্তত এক জন করে ক্যানসার রোগী থাকবে। এই রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্য যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তাই সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার-চিকিৎসা বিনামূল্যে করার সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছিলেন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি-সহ সব চিকিৎসাই হবে নিখরচায়। যদিও বাস্তবে একাধিক হাসপাতালে মাঝেমধ্যেই ক্যানসারের ওষুধ অমিল হয়ে যায়। তার উপরে এই পে ক্লিনিকগুলির অস্তিত্ব মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণাকে আরও বেশি করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে।
যেখানে দু’টাকায় আউটডোর টিকিট করিয়ে বিনা পয়সায় সমস্ত চিকিৎসা পাওয়ার কথা, সেখানে পে ক্লিনিকে ১০০ টাকার ফি শুধু নয়, রেডিওথেরাপির জন্য খরচ করতে হয় ছ’হাজার টাকা। তাড়াতাড়ি ডেট পাওয়া যাবে বলে ইতিমধ্যেই একাধিক হাসপাতালে গরিব ক্যানসার রোগীদের বিভ্রান্ত করে পে ক্লিনিকে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। দু’টাকার আউটডোর টিকিট করালেই যে পরিষেবা বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা, সেই পরিষেবার জন্যই অসংখ্য গরিব রোগীকে কার্যত জোর করেই হাসপাতালের পে ক্লিনিকে পাঠিয়ে ছ’হাজার টাকা খরচ করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ জমা পড়েছে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও।
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যখন সব কিছু ফ্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ধাপে ধাপে সবই ফ্রি হবে। ক্যানসার চিকিৎসা মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। সরকারি হাসপাতালে যাতে কোনও খরচ না হয়, তাই পে ক্নিনিকের অস্তিত্বও লোপ পাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।’’