প্রতীকী ছবি।
‘এখনও মোবাইল নিয়ে বসে আছিস? পরীক্ষায় ডাহা ফেল করবি!’ বার বার একই কথা বলেচললেও আট বছরের মেয়েটি তখনও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। শেষমেশ রেগে গিয়ে তার মা কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন মেয়েকে। এর পরে বই নিয়ে পড়তে বসলেও, দু’টি চোখ জলে ভরে উঠল মেয়েটির।
মানসিক রোগের চিকিৎসক থেকে মনোবিদ, সকলেই একবাক্যে বলছেন, এই ধরনের ঘটনা সদর্থক ‘পেরেন্টিং’-এর উদাহরণ নয়। কারণ, বাবা-মায়েদের বুঝতে হবে, বয়সের তুলনায় শিশুরা এখন অনেক পরিণত। বিশেষত ডিজিটাল দুনিয়ায় তারা বড়দের থেকে বেশি সড়গড়। তাই মোবাইল নিয়ে বসে থাকলে ছেলেমেয়েকে মারধর করে পড়াতে বসানোর পন্থা সেকেলে। বরং তারা কী দেখছে, কী জানছে, সেটা জানা দরকার। তার পরে যুক্তির মাধ্যমে পড়তে বসার কথা বলা প্রয়োজন, এমনটাই মত চিকিৎসকদের। কিন্তু প্রশ্ন হল, অভিভাবকেরা কি সদর্থক পেরেন্টিংয়ের আসল সংজ্ঞাটি জানেন?
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বাবা-মা কেমন হওয়া উচিত? এটা বড় একটা প্রশ্ন। প্রত্যেক বাবা-মা নিজেদের তৈরি করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের দেখে। কিন্তু প্রযুক্তির সঙ্গে যুগেরও পরিবর্তন ঘটেছে। সেখানে বাবা-মাকেও এখন বুঝতে হবে, কতটা ছাড়তে বা ধরতে হবে সন্তানকে।” চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই জায়গাতেই বড় রকমের ফাঁক তৈরি হচ্ছে। যেখানে অধিকাংশ বাবা-মাও সংশয়ে থাকেন। শহরের একটি মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার সংস্থার ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে শনিবার উঠে এল সেই কথাই। আলোচনায় ছিলেন সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের কলা বিভাগের ডিন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যেরা। সকলেই জানাচ্ছেন, পরিণত বা সদর্থক অভিভাবকত্বে প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে যুক্তিনির্ভর ও বাস্তবধর্মী। তা না হলে সন্তানের মানসিক সমস্যা বা অস্থিরতা তৈরির নেপথ্যে মূল কারণ হবে বাবা-মায়ের অত্যধিক শাসন বাভুল পদক্ষেপ।
সন্তানকে বড় করার ধারণা এখন পাল্টে গিয়েছে অনেকটাই। প্রতি পদে মনে রাখতে হবে, ছোটদের নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ কখনওই তাদের উপরে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়। মনোরোগ চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, সন্তানদের থেকে অত্যধিক প্রত্যাশার নেপথ্যেও রয়েছে সামাজিক কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই সন্তান পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে মা-বাবা মনে করেন, তাঁদের সম্মানহানি হয়েছে। সেটা মানতে পারবেন না বলেই অভিভাবকেরাও সন্তানদের উপরে যাবতীয় প্রত্যাশা পূরণের ভার চাপিয়ে দেন। তুলনা করেন অন্যের সঙ্গে।
পেরেন্টিং কনসালট্যান্টদের মতে, আজকের যুগে প্রত্যাশাও হতে হবে বাস্তবধর্মী। চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নয়, দায়িত্ববোধ শেখানোর মধ্যে দিয়েই সন্তানের থেকে ভাল কিছু পাওয়ার আশা করতে হবে বাবা-মাকে। মনোবিদ ইন্দ্রাণী দত্ত জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে সন্তান কত বেতনের, কী পদে চাকরি করবেন, তা-ও ঠিক করে দেন অনেক অভিভাবক। কিন্তু তা ঠিক নয়। অযথা প্রত্যাশার পাহাড় তৈরিনা করে বরং সন্তানকে হিসেব কষে ঝুঁকি নিতে সহযোগিতা করা উচিত। যাতে সমস্যার মোকাবিলা করার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে ছোটরা।
মনোরোগ চিকিৎসক, মনোবিদ সকলেই বলছেন, “সদর্থক পেরেন্টিংয়ের বিষয়টিই অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। যা বুঝতে হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। অনেক বাবা-মায়েরা নিজেরাই জানেন না যে, কী করবেন। তাই এখন সময় এসেছেসদর্থক অভিভাবকত্ব নিয়ে আলোচনার ও শেখার।”