—প্রতীকী ছবি।
অনেক সময়েই মানসিক অবসাদ থেকে বার করে আনতে পারে হালকা ধরনের সুর-তাল-ছন্দ। কাটিয়ে দিতে পারে দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক। আবার, সুরের স্পর্শে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীও অনেক সময়ে ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত সেই মিউজ়িক থেরাপি একই রকম ভাবে বদলে দিতে পারে বাড়ির পোষ্য বা যে কোনও প্রাণীর আচরণও।
সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর কয়েকটি ঘোড়ার মানসিক অস্থিরতা কাটাতে ভরসা রাখা হয়েছিল এই মিউজ়িক থেরাপির উপরে। দশ-বারো দিন পরে তার সুফলও মেলে হাতেনাতে। যা দেখে কলকাতা পুলিশের পশু চিকিৎসক সুরজিৎ বসু বলছেন, ‘‘ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের হালকা সুর ঘোড়ার মানসিক স্থিরতার উপরে যে কার্যকরী, তা বিদেশের কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণিত। দেখা গিয়েছে, হালকা ধরনের সুর ঘোড়ার স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্রের উপরে প্রভাব ফেলে। তাতে উত্তেজনা যেমন কমে, তেমনই কোনও কারণে আতঙ্ক তৈরি হলে সেটিও কাটানো সম্ভব।’’ তিনি আরও বলছেন, ‘‘বিদেশের গবেষণা এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের উপরে মিউজ়িক থেরাপির প্রভাবের বিষয়গুলিকে সম্মিলিত করে, তা আতঙ্কিত ঘোড়াগুলির উপরে প্রয়োগ করি।’’
মানুষ বা গৃহপালিত পশু, যে কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীর মূল স্নায়ুতন্ত্র একই রকম হওয়ার কারণে সঙ্গীতের হালকা সুর উভয়ের ক্ষেত্রেই কার্যকরী হওয়া স্বাভাবিক বলে জানাচ্ছেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, কলকাতা’র (আইআইএসইআর) বিহেভিয়োরাল বায়োলজিস্ট অনিন্দিতা ভদ্র। তিনি বলেন, ‘‘বিদেশে উদ্বেগ, অবসাদে বা আতঙ্কে থাকা পোষ্যদের উপরে মিউজ়িক থেরাপি প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে। তাতে ভাল ফল পাওয়ার বিষয়টিও বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে।’’ অনিন্দিতা জানান, অনেক সময়েই দেখা যায়, পোষ্য কুকুরটি বেশি চিৎকার করছে, অল্পে ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, একা রাখলে সব ছিঁড়ে ফেলছে। পশু চিকিৎসকেরা যদি সে ক্ষেত্রে মিউজ়িক থেরাপি ব্যবহারের সুপারিশ করেন, তবে তা অনেক বেশি কার্যকরী হতে পারে।
জানা যাচ্ছে, ইডেনে আতশবাজি প্রদর্শনীতে জখম হওয়ার পরে কার্যত খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে আস্তাবলে সিঁটিয়ে থাকছিল কয়েকটি ঘোড়া। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পরে চিকিৎসকেরা বোঝেন, ইডেনের ঘটনার আতঙ্ক চেপে বসেছে তাদের মনে। তখন টানা কয়েক দিন ধরে ওই আতঙ্কিত ঘোড়াদের শোনানো হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, জার্মান সুরকার বিঠোফেনের সুর। সুরজিৎ জানাচ্ছেন, ঘোড়ার চলাফেরায় নিজস্ব একটা ছন্দ রয়েছে। আর যে কোনও শব্দ শুনতে তাদের কান ১৮০ ডিগ্রি ঘুরতে পারে। তাই নিয়মিত সুর-তাল শোনানো শুরু হলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তাদের আচরণে পরিবর্তন আসছে। পরবর্তী সময়ে ওই দলে থাকা দু’টি ঘোড়া জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে স্বর্ণপদকও পেয়েছে।
বেশ কয়েক বছরে প্রায় ২৫ জন রোগীর উপরে মিউজ়িক থেরাপি প্রয়োগ করে তার সুফল পেয়েছে এসএসকেএমের ফিজ়িক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ (পিএমআর)। বিভাগীয় প্রধান, চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক জানান, মস্তিষ্কের উপরিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সারা শরীরে সঞ্চালিত হয়। অনেক সময়েই বিভিন্ন অসুখ বা অন্য কারণে সেই ক্ষমতা নষ্ট হয়। সেই সময় মিউজ়িক থেরাপিতে হালকা ধরনের সঙ্গীতের তরঙ্গ শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। রাজেশ বলেন, ‘‘অনুমান করা হয়, ওই তরঙ্গ অন্য কোনও পথ দিয়ে নিস্তেজ বা অতি সক্রিয় হয়ে থাকা স্নায়ুর উপরে প্রভাব ফেলে তাকে পুনরায় সচল করে। যদিও বিষয়টি এখনও গবেষণার স্তরে রয়েছে।’’ গৃহপালিত পশু, বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রেও ওই তরঙ্গ ঠিক একই রকম ভাবে কাজ করে বলে জানাচ্ছেন রাজ্যের প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও গবেষক শুভ্রাংশু পান। তাঁর কথায়, ‘‘মিউজ়িক থেরাপি বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রেও কার্যকরী, সেটা পরীক্ষায় প্রমাণিত। কারণ গৃহপালিত, বন্যপ্রাণী এবং মানুষের মানসিকতা ও আচরণে বহু মিল রয়েছে। কিন্তু সেটা পশুপ্রেমী ছাড়া বোঝেন ক’জন?’’