স্বাদের অন্বেষণে ঢুঁ মেরে আসতেই পারেন ব্যোমকেশের বাড়ি থেকে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
সাহিত্যের পাতা থেকে বেরিয়ে বড় পর্দায়ও ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী। সত্যান্বেষীর মাদকতায় আচ্ছন্ন আট থেকে আশি সকলেই। ব্যোমকেশ মানে বাঙালির কাছে এক আলাদা নস্টালজিয়া। ৬/৩ রামনাথ মজুমদার স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউসের ছোট এক কামরার ঘরেই হয়েছিল ব্যোমকেশের জন্ম। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন বইপাড়ার কাছের এই বোর্ডিং হাউসেই। এই সময়েই ব্যোমকেশ চরিত্রটি নিয়ে খসড়া লিখতে শুরু করেন সাহিত্যিক। শুরু হয় বাংলা সাহিত্যে ব্যোমকেশ, অজিত আর সত্যবতীর যাত্রা। প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউসের দরজা এখন বন্ধ। ‘ব্যোমকেশের বাড়ি’র ঠিকানায় এখন রমরমিয়ে চলছে মহল হোটেল। তিনটি সিঁড়ি ভাঙলেই ছোট একটি কামরা, টিমটিম করছে আলো আর সেখানেই দুপুরের খাওয়া সারছেন কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপক, বইপাড়ায় কেনাকাটা করতে আসা মানুষ থেকে মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারবাবুরা। ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটে। হোটেলের ভিতর আর জায়গা খালি নেই, চোখে পড়ল খাবারের জন্য হোটেলের বাইরে অপেক্ষারত মানুষের ভিড়।
শুক্তো থেকে কচি পাঁঠার ঝোল— বাঙালি হেঁশেলে যা যা পদ হয়, কমবেশি সবই পেয়ে যাবেন এই ঠিকানায়। ছবি: সংগৃহীত।
সালটা ১৯১৭। নন্দলাল দত্ত তৈরি করেছিলেন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস। কেবল থাকাই নয়, বোর্ডারদের জন্য খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল সেখানে। প্রথম থেকেই এই বোর্ডিং হাউসের রান্নার বেশ সুখ্যাতি। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল সদস্য সংখ্যা। জীবনানন্দ দাশও এককালে থেকেছেন এই ঠিকানায়। আশির দশকে বন্ধ হয়ে যায় বোর্ডিং হাউস। ১৯৯১ সাল ঠাকুরদার বোর্ডিং হাউসের হেঁশেলেই ‘মহল হোটেল’ শুরু করেন সন্দীপ দত্ত। কলকাতাবাসী তো বটেই, বাংলাদেশের বাসিন্দাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় এই ভাতের হোটেল। সকাল সকাল বাজারের থলি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সন্দীপবাবু। কলেজ স্ট্রিট বাজার থেকে টাটকা মাছ, মাংস, আনাজপাতি সবটাই তিনি কিনে আনেন নিজে পরখ করে। মাছের গুণমানের সঙ্গে কোনও রকম আপস করতে নারাজ তিনি। শুক্তো, মুগের ডাল, মুড়িঘণ্ট, পোস্তর বড়া, মাছের ১৫ থেকে ২০টি পদ, দেশি মুরগির ঝাল থেকে কচি পাঁঠার ঝোল— বাঙালি হেঁশেলে যা যা পদ হয়, কমবেশি সবই পেয়ে যাবেন এই ঠিকানায়। নব্বইয়ের দশকের ঐতিহ্য মেনে আজও এই হোটেলে কোনও মেনুকার্ড নেই। সন্দীপের কথায়, ‘‘আমাদের কোনও পদেরই কোনও নির্দিষ্ট দাম নেই। বাজারে যে দিন যে দামে মাছ পাওয়া যায়, আমাদের হোটেলেও সে দিন সেই অনুযায়ী খাবারের দাম ঠিক হয়। ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ির বদলে এখন সাদা বোর্ডে স্কেচপেন ব্যবহার করি। বদলেছে শুধু ওইটুকুই।’’
মহল হোটেলে কম্পিউটার নেই, হিসাব সারা হয় কাগজেকলমেই। কোন চেয়ারের অতিথি কী কী খেয়েছেন, খাওয়াদাওয়ার শেষে দ্রুত লয়ে বিলিং কাউন্টারে বলতে থাকেন পরিবেশক। ৩০ বছর ধরে একই সুরে বলতে থাকায় মনে হয় যেন ছন্দোবদ্ধ কোনও গান।
জায়গা সীমিত, তাই মহলে খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে গেলে হাতে সময় নিয়ে যেতে হবে। —নিজস্ব চিত্র।
মহলে ঢুঁ মারলে শুক্তোটা চেখে দেখতেই হবে। এ ছাড়া, এই হোটেলের মুড়িঘণ্ট, মাছের ডিমের বড়া আর জিরেবাটা, কাঁচকলা, আলু দিয়ে কাতলা মাছের ঝোলের স্বাদ অপূর্ব। ইলিশ ভাপা, ট্যাংরা মাছের রসা, চিতল পেটি কোর্মা, তপসে ফ্রাইয়ের স্বাদও অনবদ্য। নিরাশ হবেন না মাংসপ্রেমীরাও। বাঙালির প্রিয় আলু দেওয়া পাঁঠার মাংসের লাল ঝোল এবং চিকেন কষা এই হেঁশেলে রোজই মেলে। তবে অন্যান্য পাইস হোটেলের মতো শিলে বাটা মশলায় রান্না হয় না এখানে। বাজারের গুঁড়ো মশলায় নয়, মিক্সিতে বেটেই ঝাল, ঝোল বানানো হয়। সারা বছর ধরে ইলিশ, চিতল, পাবদা, চিংড়ি মাছের কদর হলেও শীতকালে কিন্তু মহলে খিচুড়ি বেশ জনপ্রিয়। শীতের মরসুমে শনিবার করে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি করা হয়। সেই খিচুড়িতে পড়ে ফুলকপি, মটরশুঁটি আর দেশি ঘি! কর্ণধর সন্দীপ বলেন, ‘‘মহলের খিচুড়ি খাওয়ার জন্য আগের দিন থেকে নাম লিখিয়ে যান অনেকেই। বহু লোক এসে ফিরেও যান। খিচুড়ির এত চাহিদা যে, সবাইকে দিয়ে পেরে উঠি না।’’
বইপাড়ায় যাঁদের রোজ যাতায়াত, তাঁদের কাছে বাড়ির খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য মহল চালু করার কথা মাথায় আসে কর্ণধারের। তাই এখানকার রান্নায় অতিরিক্ত তেলমশলা, ঝালের ব্যাপার নেই। একেবারে বাড়ির হেঁশেলের স্বাদ পাবেন মহলের রান্নায়। ক্লাসের ফাঁকে দুপুরের খাওয়া সারতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মহলে এসেছেন অভিরূপ হালদার। কলেজ স্ট্রিট চত্বরে এত হোটেল থাকতে মহলই কেন? অভিরূপ বললেন, ‘‘মহলের খাবার এক বার যে খাবে, তারই মুখে লেগে থাকবে। আমি মফস্সলের ছেলে, পড়াশোনার কারণে বাড়ি থেকে দূরে থাকি। মহলে এসে আমি মায়ের হাতে তৈরি খাবারের স্বাদ পাই।’’ বাংলাদেশ থেকে মেয়ের বিয়ের কেনাকাটা করতে এসেছেন রজ্জাক আহমেদ। রজ্জাক বললেন, ‘‘যখনই কলকাতায় আসি, এখানে এক বার ঢুঁ মেরে যাই। মহলের খাবার আমার বেশ মজার লাগে। এখানে এলে ইলিশের ঝাল আর মুড়িঘণ্ট তো খেতেই হবে।’’
জায়গা সীমিত, তাই মহলে খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে গেলে হাতে সময় নিয়ে যেতে হবে। তবে চিন্তার কিছু নেই, এখন মহলের খাবার মেলে সুইগি, জ়্যোম্যাটোতেও। শুধু তা-ই নয়, বিয়ের ভোজ রান্নারও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে মহল। বোর্ডিং, পাইস হোটেলের পথ পেরিয়ে এখন ক্যাটারিংয়ের ব্যবসায় নেমেছেন সন্দীপরা। সেখানেও সন্দীপের একই কথা, ‘‘খাবারের গুণমানই আমাদের ইউএসপি। ওটার সঙ্গে আপস করব না কখনওই।’’
শহরের আর পাঁচটা পাইস হোটেলের ইতিহাস যেখানে একশো বছরের পুরোনো, সেই দলে নাম নেই মহলের। মাত্র ৩০ বছরের যাত্রাপথ। তবে এ ক’টা বছরেই বইপাড়ায় বেশ নামডাক মহলের। শহরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তরাঁগুলির মতো অন্দরসজ্জায় চাকচিক্য নেই মহলের কিন্তু খাবারের স্বাদে সেই সব রেস্তরাঁগুলিকে কয়েক গোল দেবে ‘মহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। ব্যোমকেশপ্রেমী হলে সত্যান্বেষীর বাড়ির ঠিকানা থেকে এক বার তো ঘুরে আসতেই হয়। ব্যোমকেশের দেখা না মিললেও আতিথেয়তার অভাব হবে না সেই বাড়িতে।