সম্প্রতি সঞ্জয় দত্ত ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। ফাইল ছবি।
আজকের নিউ নর্মাল জীবনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। মাস্ক, ফেস শিল্ড, স্যানিটাইজার, সাবান এখন আমাদের জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গী। এই সময়ে কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট হলে একরাশ আতঙ্ক গ্রাস করে। কোভিডের ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তবে নভেল করোনার থেকেও এক কষ্টকর অসুখের উপসর্গ লাগাতার কাশি, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। ঠিক এই রকম উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত। টেস্ট করে জানা গেছে নভেল করোনা ভাইরাস নয়, তাঁর ফুসফুস আক্রান্ত কর্কট রোগে। স্টেজ থ্রি ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত মুন্নাভাই।
চিকিৎসার জন্যে পাড়ি দিচ্ছেন আমেরিকায়। এই প্রসঙ্গে সার্জিকাল অঙ্কোলজিস্ট গৌতম মুখোপাধ্যায় জানালেন, ধূমপানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে ফুসফুসের ক্যানসারের। স্টেজ থ্রি মানে অসুখ বেশ কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছে। ফুসফুসের সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়েছে লিম্ফ নোডেও। এই অসুখের চিকিৎসা যে দেশেই হোক না কেন, কী ফল হবে তা নির্ভর করছে ক্যানসারের ধরন অনুযায়ী।
গৌতম মুখোপাধ্যায় বললেন যে, ফুসফুসের ক্যানসারের মূল কারণ ধুমপান। সঞ্জয় দত্তর ক্যানসারটি ঠিক কী ধরনের তা জানতে গেলে তাঁর বায়োপ্সি রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখা দরকার। কিছু কিছু ক্যানসার আগ্রাসী ধরনের হয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা করে খুব ভাল ফল আশা করা মুশকিল। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে এবং ক্যানসার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকলে অস্ত্রোপচারের সাহায্যে ক্যানসার আক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সাধারণত স্টেজ থ্রি লাং ক্যানসারের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়। গৌতমবাবুর মতে, হয়তো বা দু’তিনটে কেমোথেরাপির পর ক্যানসারের ধরন ও চিকিৎসায় কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ট্রিটমেন্ট প্রটোকল ঠিক করা হবে।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে পালস অক্সিমিটার ঘরে রাখা জরুরি? কী মত চিকিৎসকদের
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে আমাদের দেশে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৭,৭৯৫। ২০২০-তে বেড়ে দাঁড়িয়েছে কম বেশি প্রায় ৬৭, ০০০। এই ক্যানসারের সব থেকে মারাত্মক দিক হল— শুরুতে এই রোগের উল্লেখযোগ্য কোনও উপসর্গ না থাকায় রোগটি সম্পর্কে আঁচ করা যায় না। যখন ধরা পড়ে, ততক্ষণে তা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।
চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের (সিএনসিআই) রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট দেবর্ষি লাহিড়ি জানালেন, ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তদের মধ্যে ৮৫ – ৯০ শতাংশ ধূমপায়ী। তাই ধূমপান আর ফুসফুসের ক্যানসার সমার্থক বললেও অত্যুক্তি হয় না। পরোক্ষ ধূমপান এবং দূষিত পরিবেশ এবং লাগাতার ধোঁয়া ও অন্যান্য রাসায়নিকের ধোঁয়ার প্রভাবে ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে, বললেন দেবর্ষিবাবু।
পরোক্ষ ধূমপান এবং দূষিত পরিবেশ এবং লাগাতার ধোঁয়া ও অন্যান্য রাসায়নিকের ধোঁয়ার প্রভাবে ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। ছবি: শাটারস্টক
বিভিন্ন রাসায়নিকের মধ্যে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, নিকেল, ইউরেনিয়াম-সহ কিছু পেট্রোলিয়াম জাত রাসায়ানিক ফুসফুসের ক্যানসার ডেকে আনে। অনেকেই অজুহাত দেখান যে, চেনা কোনও মানুষ দিনে ১০ – ১৫ টা সিগারেট টেনেও ৮০ বছর পর্যন্ত বহাল তবিয়তে ছিলেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নাকি দিনে ২০ টি করে সিগারেট টেনে ১১০ বছর সুস্থ জীবন কাটিয়েছেন। একটা বিষয় প্রমাণিত যে, তামাকের ধোঁয়ায় থাকা অজস্র রাসায়নিক ফুসফুসের কোষ কলার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। বংশে থাকলে ক্যানসারের ঝুঁকি বহু গুণ বেড়ে যায় বলে জানালেন দেবর্ষিবাবু। এছাড়া রেডিয়েশন থেকেও ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। সঞ্জয় দত্তর যে স্টেজ থ্রি ক্যানসারের কথা শোনা যাচ্ছে, তার আগেও দু’টি স্টেজ আছে। স্টেজ ১-এ ক্যানসার শুধুমাত্র ফুসফুসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। স্টেজ ২-তে ফুসফুস ও কাছাকাছি লিম্ফ নোডে ক্যানসার পৌছে যায়, কিন্তু ফুসফুসের বাইরে যায় না। স্টেজ থ্রি-তে ফুসফুসের বাইরের দেওয়ালের লিম্ফ নোডে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। আর স্টেজ ৪-এ দু’টি ফুসফুস সহ শরীরের অন্যান্য অন্যান্য অংশেও রোগ ছড়ায়। স্টেজ ১ বা স্টেজ ২-এ ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসা করে তুলনামূলক ভাল ফল পাওয়া যায় বলে গৌতম মুখোপাধ্যায়ের অভিমত।
আরও পড়ুন: কখন প্রয়োজন ভেন্টিলেটর? কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার এটির?
করোনার এই সময়টায় সর্দি কাশি হলে বেশির ভাগ মানুষই কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয় পান। কিন্তু ফুসফুসের ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ কাশি। বিশেষ করে যাঁরা ধূমপায়ী, বংশে এই অসুখের ইতিহাস আছে বা পরোক্ষ ধূমপানের মধ্যে থাকেন, তাঁদের চিকিসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং এসব তথ্য জানাতে হবে বললেন দেবর্ষিবাবু।
যে সব লক্ষণ দেখলে ফুসফুসের ক্যানসারের ব্যাপারে সন্দেহ করতে হবে সেগুলি হল—
• কাশি শুরু হয়েছে, কিছুতেই কমছে না, লাগাতার কাশির দমক চলছে।
• কাশির সঙ্গে সামান্য হলেও রক্ত উঠছে।
• বুকে ব্যথা, নাগাড়ে ব্যথা থেকে যেতে পারে।
• মাঝে মাঝে ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসের সম্ভাবনা।
• শ্বাসকষ্ট।
• মাথার যন্ত্রণা।
• কোনও কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
• গলা ধরে যাওয়া বা গলার স্বর বদলে যাওয়া।
• বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ।
• খিদে কমে যাওয়া।
• খাবার গিলে খেতে অসুবিধা হওয়া।
• সারাক্ষণ ঝিমিয়ে থাকা।
• হাড়ে ব্যথা।
সাধারণত এই ধরনের উপসর্গ হলে (কাশির সঙ্গে রক্ত বেরনো ছাড়া) বেশির ভাগ মানুষই পাত্তা দেন না। যখনই দু’একটি উপসর্গ দেখা যাবে এবং তিনি যদি ধূমপায়ী হন, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে একটা চেস্ট এক্স রে করিয়ে নেওয়া উচিত। দরকার মতো সিটি স্ক্যান, এফএনএসি বা বায়োপ্সি করতে হতে পারে, বললেন দেবর্ষিবাবু। রোগের স্টেজিং অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসা একটা নির্দিষ্ট বিধি মেনে করা হয়। আমাদের দেশেও সেই একই নির্দেশিকা মেনে চিকিৎসা করা হয়। ছোট টিউমারের ক্ষেত্রে সার্জারি করা যেতে পারে। বড় টিউমার ও ক্যানসার ছড়িয়ে গেলে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: গ্যাস-অম্বলের সমস্যায় মুঠো মুঠো ওষুধ? বাড়ছে করোনার ঝুঁকি
অ্যাডভান্সড লাং ক্যানসারের ক্ষেত্রে ইমিউনোথেরাপি করে কিছুটা ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে এই রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করা উচিত। ধূমপান ছেড়ে, পরোক্ষ ধূমপানের থেকে দূরে থেকে, সঠিক খাবার খেয়ে নিয়মিত শরীরচর্চা করে ওজন ঠিক রেখে ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে হবে। আর কোনও রকম শারীরিক সমস্যা হলে নিজে থেকে ওষুধ না খেয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।