লোকে কী বলবে! সঙ্গে অনুত্তমা ছবি: নিজস্ব চিত্র
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ঠিক কী? নিশ্চিত করে উত্তর দিতে পারেন না কেউই। কিন্তু নিজের দৃষ্টিতে কাউকে পছন্দসই না মনে হলেই তাঁকে অসুন্দর বলে দাগিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব নেই দুনিয়ায়। ‘রোগা না স্বাস্থ্যকর’, ‘লম্বা না বেটে’, ‘গায়ের রংটাই বা কী’, ‘দাঁতটা কেমন’- প্রতিদিন এমন হাজার প্রশ্ন ও ক্ষেত্র বিশেষে ব্যঙ্গের সম্মুখীন হতে হয় অসংখ্য মানুষকে। অথচ যাঁদের উদ্দেশ্যে এই মন্তব্যগুলি করা হয়, তাঁদের কেমন লাগে তা ভেবে দেখার অবকাশটুকুও পান না মন্তব্যকারীরা। তেমনই কিছু অনুভূতির কথা রবিবার উঠে এল আনন্দবাজার অনলাইনের ইউটিউব এবং ফেসবুকের অনুষ্ঠান ‘লোকে কী বলবে! সঙ্গে অনুত্তমা’-র নবম পর্বে। এ সপ্তাহের প্রসঙ্গ ‘যদি দেখতে খারাপ লাগে?’
সমাজ যে ঠিক কী দেখতে চায়, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর জানা নেই কারওই। এক দিকে ওজন কম হওয়ার কারণে শিবনাথ নিমন্ত্রণ বাড়িতে যেতেও কুণ্ঠা বোধ করেন, পাছে তাঁকে অপুষ্ট বলা হবে, আবার অন্য দিকে নীলাঞ্জনা জানাচ্ছেন কী ভাবে ওজন বেশি থাকার জন্য বক্রোক্তি শুনতে হয়েছে তাঁকে। কী ভাবে তাঁকে তুলনা করা হয়েছে হাতির সঙ্গে। মনোবিদ অনুত্তমা জানাচ্ছেন, ওজনের সঙ্গে স্বাস্থ্যের কিছুটা সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওজন নিয়ে ধেয়ে আসা মন্তব্যগুলি আদৌ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নয়। এই মন্তব্যগুলির পিছনে আদপে, ‘‘আমাদের দেখার চোখের আপেক্ষিকতা’’ রয়েছে বলেই মত মনোবিদের। চিকিৎসক ছাড়া অন্য কারও করা ওজন সম্পর্কিত অযাচিত মন্তব্য থেকে দূরত্ব বজায় রাখারও পরামর্শ দেন তিনি।
তবে দেহ নিয়ে তির্যক মন্তব্য শুধু ওজনেই সীমাবদ্ধ নেই। কেউ কেউ জানাচ্ছেন, লম্বা চুল কেটে ফেলা নিয়েও তাঁদের শুনতে হয়েছে নানা রকম কুরুচিপূর্ণ কথা। এমনকি চুলের দৈর্ঘ্যকে কেন্দ্র করে নারীত্ব নিয়েও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের। এখান থেকেই উঠে আসে কিছু নির্দিষ্ট দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে প্রামাণ্য ধরে নিয়ে লিঙ্গ চরিত্র নির্মাণের প্রবণতার কথাও। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এই সামাজিক প্রবণতার শিকার। জনৈক ব্যক্তি জানাচ্ছেন শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁর স্তনের আকার বৃদ্ধি পায়, এই নিয়ে নানা রকম কুরুচিকর মন্তব্য ধেয়ে আসে তাঁর দিকে। এখানেই শেষ নয়, কেউ জানাচ্ছেন গলার স্বর যথেষ্ট ‘পুরুষালি’ না হওয়ায় তিনি গান গাইতে লজ্জা পান, কেউ আবার জানাচ্ছেন শরীরে যথেষ্ট দেহকেশ না থাকায় বক্রোক্তি শুনতে হয় তাঁকে। আর এ সব কিছুর সঙ্গে গায়ের রং কিংবা দাঁতের গড়নের মতো বিষয় নিয়ে মন্তব্য তো রয়েছেই। অর্থাৎ, দেহ ও রূপ সংক্রান্ত কোন বিষয় যে গঞ্জনার কারণ হয়ে উঠবে, তা কেউই জানেন না। মনোবিদ অনুত্তমা জানান, এই সব কথার পিছনে সমাজের নিজেকে দেখার এক প্রকারের কঠোর প্রবণতা আছে। তাই সেই প্রবণতার বাইরে বেরিয়ে নিজের চোখে নিজের লিঙ্গ পরিচয় ও সৌন্দর্যের ধারণা নির্মাণ করা খুবই জরুরি। যাঁরা এ ধরনের কথা বলছেন তাঁদের নিয়ে অনুত্তমার মত, ‘‘তাঁরা তাঁদের মতো করে বলছেন। তাঁরা তাঁদের নিজেদের মানদণ্ড নিয়ে বলছেন। হয়তো তাঁরাও এমন একটি ব্যবস্থায় পড়ে গিয়েছেন, যাতে তাঁরা এই ভাষাটাই শিখেছেন।’’ মনোবিদের আশা, ‘‘আজ কিছু মানুষ যখন অন্য ভাবে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিরুপিত করবে, তাঁদের দেখতে দেখতে হয়তো ওঁদের ভাষাতেও বদল আসবে। হয়তো ওঁদের ভাবনার নির্মাণকেও আমরা আমাদের উদ্যাপন দিয়ে বদলাতে পারব। হয়তো সময় লাগবে কিন্তু আমরা যেন আমাদের নিজেদের বিশ্বাস থেকে এখনই নড়ে না যাই।’’