লোকে কী বলবে! সঙ্গে অনুত্তমা ছবি: সংগৃহীত
বাড়ির আর এক নাম বাসা। কিন্তু সেই বাসাতেই যদি ভালবাসা না থাকে, তবে কি তাকে ‘ভাল বাসা’ বলা যায়? যে বাড়ি প্রাণের আরাম, সেখানেই যদি স্বস্তি না থাকে, তবে ‘ঘরে ফেরার ঘর’ খুঁজে পান না অনেকেই। কিন্তু কী কী কারণে ভাঙে পরিবার? ‘আলাদা’ হওয়ার বাসনা কি শুধুই স্বেচ্ছাচার কিংবা শুধুই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা? না কি তার পিছনে রয়েছে গভীরতর কোনও সঙ্কট? এক এক মানুষের ‘আলাদা হওয়ার’ বা ‘আলাদা হতে চাওয়ার’ এমনই এক এক রকমের আখ্যান রয়েছে। তেমন কিছু অনুভূতির কথা রবিবার উঠে এল আনন্দবাজার অনলাইনের ইউটিউব এবং ফেসবুকের অনুষ্ঠান ‘লোকে কী বলবে! সঙ্গে অনুত্তমা’-র সপ্তম পর্বে। এ সপ্তাহের প্রসঙ্গ ‘যদি বাড়ি থেকে আলাদা হই?’
বাড়ি থেকে আলাদা হওয়ার কারণ, প্রেক্ষিত কিংবা ব্যক্তিমানুষের সঙ্কটের ধরন, সবই হয়তো আলাদা। কিন্তু যন্ত্রণার জায়গাটি অনেক ক্ষেত্রেই এক ধাঁচের। বিশেষত, কারও বিয়ের পর পরিবারের নতুন সদস্য বা সদস্যাকে নিয়ে টানাপড়েন তৈরি হওয়াও অতি পরিচিত দৃশ্য। এমনই কয়েকটি ক্ষতের বয়ান উঠে এল অনুষ্ঠানে। ই-মেল মারফত পাঠানো চিঠিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানালেন, কী ভাবে বিয়ের পর বন্ধ হয়ে আসছে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ। জানালেন স্বামী-শ্বশুরবাড়ির চাপে শিক্ষকতা করতে চাওয়ার স্বপ্নের অপমৃত্যুর আশঙ্কা বাড়াচ্ছে মানসিক অবসাদ।
আবার জনৈক ইন্দ্রাণী জানান, বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শ্বশুরবাড়ির মানুষজন তাঁকে এমন কিছু কথা বলছেন যে, তাঁর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু তিনি নিজেও বয়ষ্ক শ্বশুর-শাশুড়িকে ছেড়ে আলাদা হয়ে ভাল থাকবেন বলে নিশ্চিত নন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শুনিয়েছেন রক্ষণশীল বাড়ির কন্যা থেকে রক্ষণশীল বাড়ির বধূ হওয়ার কাহিনি। জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষিকার ভূমিকা পালন করা ও মহিলা সমিতির মাথা শাশুড়ি মা কী ভাবে তাঁকে চাপ দিয়েছেন পুত্র সন্তানের জন্য, কী ভাবে শেষ পর্যন্ত পরিবার থেকে আলাদা হতে হয়েছে তাঁকে। সেই আলাদা হওয়া কী ভাবে তাঁর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ককে ঠেলে দিয়েছে অনন্ত শীতলতার দিকে, সে কথাও প্রকাশ করেছেন।
আমেরিকা নিবাসী গবেষক ঈশিতা জানিয়েছেন, শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। কখনও পছন্দের পোশাক পরা নিয়ে, কখনও লিপ বাম লাগানো নিয়ে। কখনও বা কটু কথা শোনানো হয়েছে তাঁর শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে। এমনকি, স্বামীর সঙ্গে আমেরিকা চলে যাওয়ার পরেও রোজ রাতে ফোন করে কটু কথা শোনানোই যেন হয়ে উঠেছে রোজনামচা।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সঙ্গে থাকা নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যা সম্পর্কে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই যে বিয়ের পর মেয়েদের মানিয়ে নিতেই হবে, এই কাঠামো বড় পুরনো। এই কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে আছে পিতৃতান্ত্রিকতা। এখনই এই সব সমস্যা ও সংঘাত মিটে যাবে, এমন আশা করা যায় না। যাঁরা এই কথাগুলি বলছেন, তাঁরা একটি বৃহত্তর তন্ত্রের অংশ। এই তন্ত্রই কোথাও গিয়ে বিবাহের পর নারীদের ভূমিকা কী হবে তার একটি ‘প্রত্যাশিত কাঠামো’ ঠিক করে দেয়। যে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি কিংবা ননদ এই ধরনের কথা বলছেন তাঁদের সম্পর্কে মনোবিদ বলেন, ‘‘এটি শুধু সেই ব্যক্তিদের আলাদা আলাদা সমস্যা নয়। এটি তাঁদের মধ্যে জমে থাকা সংস্কারের সমস্যা।’’ এই সমস্যাগুলি সমাধানের একমাত্র পথ হতে পারে পারস্পরিক সংলাপ। খুব রাগ থেকে কিংবা প্রচণ্ড অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বদলে চেষ্টা করতে হবে যাতে কথা বলে ধারণার এই অচলায়তন ভেঙে ফেলা যায়। পাশাপাশি, তিনি জানান, এ ক্ষেত্রে আবার কখনও কখনও দেখা যায় বাড়ির ছেলেটি অসহায় হয়ে যান। কারণ বিবাদের দু’পক্ষের মানুষই তাঁর প্রিয়জন।
কেউ কেউ আবার নিজের বাড়িতেই অপর হয়ে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নিজের বাড়িতে তিনি কখনওই সুখী ছিলেন না। বরং অনেকটাই ভাল ছিলেন শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে থেকে। কিন্তু আচমকাই স্বামীর মৃত্যু হয়। ফিরে যান বাবা-মায়ের বাড়িতে। আর সেখান থেকে নতুন করে সমস্যা বাড়ে। আর নানা কথায় উঠে আসে নিজের পরিবার থেকে আলাদা থাকার ইচ্ছাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অপরাধবধের প্রসঙ্গে। অনুত্তমার পরামর্শ, ‘‘পারস্পরিক সংঘাত, পারস্পরিক ঘর্ষণ কমাতে পরিবারের থেকে আলাদা থাকাকে ত্যাগ করার মতো করে না দেখে, একে আমি আর একটু পরিসরের ব্যাপ্তিতে গেলাম বলেও তো দেখতে পারি। নিজের পরিবারের ক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে, বিবাহজনিত পরিবারের ক্ষেত্রেও তা হতে পারে।’’
তবে সম্পূর্ণ উল্টো একটি ছবিও রয়েছে। এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তিনি প্রতিনিয়ত দেখেন তাঁর সত্তরোর্ধ্ব প্রতিবেশীর বেঁচে থাকার লড়াই। বৃদ্ধ মানুষটির দুই সন্তানই তাঁকে বুঝিয়ে দেন, বাড়িতে থাকতে গেলে বিসর্জন দিতে হবে নিজের সমস্ত ভাললাগা। নিরন্তর আসে বৃদ্ধাশ্রমের প্রস্তাবও। অনুত্তমার পরামর্শ, এ ক্ষেত্রে প্রথমেই কথা বলতে হবে দুই সন্তানের সঙ্গে। কাজ না হলে সুযোগ রয়েছে আইনের শরণাপন্ন হওয়ার।
অনুষ্ঠানের শেষে উঠে আসে একেবারে আলাদা একটি ভাষ্য। বেসরকারি সংস্থার কর্মী সোনালি ভুঁইয়া জানান, তিনি জীবনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পুরোপুরি একা থাকার। দু’কামরার ফ্ল্যাটে নিজের মতো করেই কাটিয়ে দিতে চান গোটা জীবন। পাড়াপড়শির কটাক্ষের পরোয়া না করেই প্রত্যাখ্যান করতে চান বিয়ে নামে প্রচলিত প্রতিষ্ঠানটিকে। এও তো এক ধরনের আলাদা থাকা! অনুত্তমার কথায়, ‘‘আমরা বাড়ি ছাড়ুন বলছি না। কিন্তু যদি এমনটা হয় যে, বাড়ির মধ্যে একত্রে থাকতে গিয়ে আমরা একে অন্যের খারাপ থাকার অংশীদার হচ্ছি, সমাধান হচ্ছে না, বারবার একই অশান্তি ও একে অপরকে বিদ্ধ করার অভিজ্ঞতায় জুড়ে যাচ্ছি, তা হলে কি কিছুটা শারীরিক দূরত্ব, দুটো আলাদা ব্যবস্থা আমাদের কিছুটা হলেও ভাল রাখতে পারে?’’
পরিবারের সঙ্গে অশান্তির কারণে আত্মহত্যার চিন্তা আসছে বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ। সে প্রসঙ্গে মনোবিদ বলেন, ‘‘আমরা জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার কথা যত সহজে ভাবি, কখনও কখনও নিজের বাড়ির থেকে একটু দূরে থাকার কথা, পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কখনও কখনও একটু গোলমেলে সংলাপে গিয়ে নিজের জায়গা তৈরি করার কথা কেন ভাবি না? একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার চেয়ে এই বিষয়গুলির মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত করার মধ্যে অনেক বেশি সমাধানসূত্র রয়েছে।’’