jamai sasthi

ষষ্ঠী, তুমি কার? শুধুই কি জামাইয়ের?

পৃথিবী উল্টে গেলেও বাবা নীল নীল দাঁড়া-নাড়ানো কিং সাইজ গলদাদের ঠিকই নিয়ে আসবেন।

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৯ ১১:২৯
Share:

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

নামের মধ্যে জামাই শব্দটা জ্বলজ্বল করলেও জামাইষষ্ঠীর উৎসব কি শুধুমাত্র জামাইদের? যদিও না-মেনে উপায় নেই যে, জামাই বাবাজীবনরাই এই দিনের মেন হিরো আর তাঁদের ঘিরেই সে দিন বাঙালি জাতির আনন্দময় হুড়োহুড়ি ও উত্তেজনা। কিন্তু জামাইকে মাঝখানে বসিয়ে যাঁরা সে দিন এই উৎসব পালন করেন, মানে শ্বশুরমশায়, শাশুড়িমা, শালা, শালি, দাদাশ্বশুর, দিদিশাশুড়ি, খুড়শ্বশুর বা মামাশ্বশুরের দল— এঁদের যদি হোকাস-ফোকাস করে এক লহমায় সরিয়ে নিই, তা হলে তো আর কিচ্ছুটি হবার জো থাকে না। মলিন মুখে জামাইটিকেও সে দিন এক জন হতভাগ্য বিবাহ বঞ্চিতের মতো আপিস-কাছারির দিকে হাঁটা লাগাতে হয়।

Advertisement

আসলে, শাশুড়িমা যদি ভোর থাকতে উঠে পান-সুপুরি-হাতপাখা নিয়ে বাটা-র জোগাড় না করেন, শ্বশুরমশায় যদি সাতসকালে বাজারে গিয়ে দিশি ভেটকিমাছ বিক্রেতার মাথাই না খারাপ করে দ্যান, তা হলে ওই দিনটাকে আর জামাইষষ্ঠী বলে মনে হবে কী করে! এ দিন জামাইয়ের ভাগ্যে যেমন যত্নআত্তি জোটে, সুখাদ্য জোটে, তেমনই শাশুড়িমার জন্য আসে জামাইয়ের কেনা নতুন শাড়ি। শ্বশুরমশায়ের জন্য আনকোরা ধুতি-পাঞ্জাবি। ছোট শালাবাবুর হয়তো গলদা চিংড়ি ভারি পছন্দের, কিন্তু অনেক দিন ওটা বাড়িতে আসছে না। ও জানে, এই দিন পৃথিবী উল্টে গেলেও ওর বাবা নীল নীল দাঁড়া-নাড়ানো কিং সাইজ গলদাদের ঠিকই নিয়ে আসবেন, কারণ, এদের মিষ্টি-মিষ্টি মালাইকারি জামাইবাবুর হট ফেভারিট।

ছোট শালির হয়তো সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক। কিন্তু এখন থেকেই ওর ওপর জামিন অযোগ্য ধারায় সিনেমা না-দেখার নিয়মটি আরোপিত হয়েছে। ও তাই আগে থাকতে জামাইবাবুকে থ্রু প্রপার চ্যানেল জানিয়ে রেখেছে, এ দিন সন্ধেবেলায় ওরা সলমন খানের একটা নতুন সিনেমা একসঙ্গে কোনও ঠান্ডা মাল্টিপ্লেক্স-এ দেখতে যাবে। আগে যে কোনও নামি রাজারাজড়ার গোলাপবাগানে যেমন দু’একটি কালো গোলাপের গাছ শোভা পেত, এখনকার যে কোনও বনেদি বাড়িতে তেমনই দু’এক পিস ডায়াবিটিক কাকাশ্বশুর বা মামাশ্বশুর হাজির থাকেন। যাঁরা, ‘আহা, নতুন জামাই আদর করে নিয়ে এসেছে গো!’ গোছের দোহাই দিয়ে নিজের সাদা গোঁফ রাবড়ির বাটিতে ডুবিয়ে এ দিন খুশিমনে চুমুক লাগান। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, জামাইষষ্ঠী হল এমনই একটি পার্বণ, যে দিন বাড়ির সবার আনন্দ, আকাশ ও সমুদ্রের মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: ইলিশ-পাবদা-চিতল-চিংড়ির আগে আমের শরবতে জামাইবরণ

এই বার মনে করুন, জামাইষষ্ঠী হয়তো ছুটির দিনে না-পড়ে কোনও উইক ডে-তে পড়ল। গিন্নির অনুরোধে জামাই সে দিন আপিস থেকে আগাম ছুটিও নিল, কিন্তু ষষ্ঠীর ঠিক দু’দিন আগে একটা জরুরি প্রজেক্ট এসে পড়ায় সেই ছুটি তাকে ক্যানসেল করতে হল। তার নতুন বউ চোখের জল চেপে নিজের বাবা-মাকে জানাতে বাধ্য হল যে, জামাইষষ্ঠীর দিন তারা কোনওমতেই যেতে পারছে না। অনুষ্ঠান হপ্তাখানেক পিছিয়ে দিতে হবে। এই আকস্মিক ঘোষণায় জামাইটির শ্বশুরবাড়ির উপরেও এক অচেনা শোকের ছায়া নেমে এল। তবে এই শোকের সবটুকুই যে জামাইবাবাজীবনের চাঁদমুখ সে দিন না-দেখতে পাওয়ার জন্য বা তার মুখনিঃসৃত সুমধুর বাণী না-শুনতে পাওয়ার দুঃখে, তা কিন্তু নয়।

নিজের মেয়েকে আরও সাত দিন পরে দেখবেন এটা তার মার কাছে যেমন একটা দুঃখের কারণ, তেমনই তিনি আবার মেয়ের কাছে জেনেছিলেন যে, জামাই এ বার তাঁর জন্য একটি ঘি-রঙা কাঞ্জিভরম কিনে রেখেছে। সেটা হাতে পাওয়ার দিনও কিছুটা পিছিয়ে গেল। ছোট শালার মুড খারাপ কারণ গলদাচিংড়ির মালাইকারি হতে গিয়েও হল না। আর এক হপ্তা পরে বাজারে ঠিক এই কোয়ালিটির গলদা উঠবে কি না বাবা নকুলেশ্বরও তা জানেন না। যেমন, সল্লুভাইয়ের নতুন আসা সিনেমাটা আরও এক হপ্তা হলে থাকবে কি না এই চিন্তাতেই যে ছোট শালির তেড়ে কান্না পাচ্ছে, সে বেচারি কাউকে সেটা মুখ ফুটে বলেও উঠতে পারছে না। কেবল মা যখন পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘এভাবে কাঁদিস না মামন, দিদি-জামাইবাবু তো পরের শনিবারেই আসবে !’, তখন তার চোখ ফেটে ফরাক্কার লক-গেট তোলার স্টাইলে হু হু করে জল বেরতে লাগল ।

আরও পড়ুন: জামাই-আদরে পাতে বোম্বে রোল, সুগার ফ্রি চিত্তরঞ্জন

এত যত্নে করা আয়োজন হঠাৎ থমকে গেল বলে প্রথমে কিছুটা কষ্ট হলেও খুব তাড়াতাড়ি তা ভুলে, গোপন হাসি ফুটে উঠল যাঁর মুখে, তিনি অবশ্যই ওই জামাইটির শ্বশুরবাবা। কারণ কে না জানে, জামাইষষ্ঠীর দিন কাঁসি থেকে খাসি, সরষে থেকে পার্শে— সব কিছুর দামই তো আকাশছোঁয়া! খাওনদাওন এক হপ্তা পিছিয়ে গেলে রোদ্দুরের সঙ্গে সেই পারদ অনেকটাই নেমে আসবে। তাই, বাজারে আসা অন্য শ্বশুরেরা যখন ঘুমন্ত ইলিশের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে, ফতুয়ার লুকনো বুকপকেট থেকে ফিকে গোলাপিরঙা দু’হাজারি নোট বার করছেন, তখন তিনি বিদঘুটে বেগুনি রঙের একশো টাকার নোট হাতে বলাই মান্নার খাব-খাব মাছের দোকানে। আজকের দিনে তাঁকে নিজের দোকানে দেখে বলাইও ভারি অবাক। প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, ‘না হে, আজ চারাপোনাই দাও...জামাইবাবাজি হপ্তাখানেক বাদে ছুটি পাবে!’

বড় মেয়েটা ষষ্ঠীর দিনে বাড়িতে এলে মুখে কুটোটাও তুলতে পারত না। দিন পিছিয়ে গেল বলে সে দিন সব কিছুই খেতে পারবে। এই কথাটা বাড়ির কাউকে বলতে না-পারলেও মনে মনে জানেন, মেয়ের মা-ও এতে যারপরনাই খুশি। আর সেই আনন্দে, আজ চারাপোনা কুটে দিল যে রোগামতো মেয়েটা, তাকে দশের জায়গায় বিশ টাকা দিয়ে তিনি এখন ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরছেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement