Self-Defense

রক্ষাকবচ

আত্মরক্ষার কৌশল জানা থাকলে বাড়বে আত্মবিশ্বাস। জেনে নিন কী কী শিখতে পারেন।

Advertisement

কোয়েনা দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৪ ০৯:০৬
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে খারাপ মন্তব্য, বাসে-ট্রেনে বা কাজের জগতে অশালীন স্পর্শ, অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় গায়ে এসে পড়া, চেনা-পরিচিত মানুষের অসভ্য আচরণ… কোনও না কোনও ক্ষেত্রে পুরুষের অশালীন আচরণের শিকার হননি এমন মহিলা খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু তা বলে দরজায় খিল এঁটে ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। বরং এমন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কিছু প্রস্তুতি রাখা ভাল। বিপদের সময়ে কাজে আসবে তা।

Advertisement

সচেতনতা আত্মরক্ষার প্রথম ধাপ: ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগান। রাস্তাঘাটে, অফিস বা কর্মক্ষেত্রে নিজের চারপাশে কী ঘটছে, তা নিয়ে সতর্ক থাকুন। কোনও পরিস্থিতি বা পরিবেশ গোলমেলে মনে হলে বা কোনও ব্যক্তি ক্ষতি করতে পারে বলে মনে হলে সাবধান থাকুন।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝা জরুরি: ক্যারাটে প্রশিক্ষক শিবায়ন গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, আত্মরক্ষার জন্য সব সময়ে লড়াই করা জরুরি নয়। বরং অনেক সময়ে সেটাই বিপদ ডেকে আনতে পারে। বুদ্ধি দিয়েও কিছু বিপদ এড়িয়ে যাওয়া যায়।

Advertisement

মাথা উঁচু রাখুন, সামনের ব্যক্তির চোখে চোখ রেখে তাকান। আত্মবিশ্বাস অনেক সময়েই অপরাধীকে ভয় পাওয়ায়।

বিবাদ বিতর্ক, সংঘাতে না গিয়ে শান্ত কথোপকথনও কিছু সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।

পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বুঝলে প্রথমেই উচ্চস্বরে কথা বলুন, যাতে আশপাশের লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।

দরকার আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ: ক্যারাটে, জুডো, তায়কোয়ন্দো, কালারিপায়াতুর মতো যে কোনও ধরনের মার্শাল আর্টস শিখতে পারেন। এতে শরীরকে অস্ত্রের মতো তৈরি করা হয়। মাথা, কাঁধ, কনুই, হাত, হাঁটু, পা… শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে আক্রমণকারীর শরীরের ঠিক কোথায়, কতটা জোরে মারলে সে কুপোকাত হবে, তা শিখে রাখুন। ১৪ বছর বয়সে ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিলেন শ্রুতি নাথ। এখন কিওকুশিন ক্যারাটের প্রশিক্ষক ২১ বছরের শ্রুতি। বলছিলেন, “পড়াশোনার মতো আত্মরক্ষার শিক্ষা অবশ্যম্ভাবী করতে হবে। ক্র্যাশ কোর্স নয়, নিয়মিত অভ্যেস করুন।” মোটামুটি চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই এখন বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চাদের ক্যারাটে, কিকবক্সিং শেখানো হয়। মার্শাল আর্টস শেখা সম্ভব না হলে, জিমে গিয়ে অন্তত স্ট্রেংথ ট্রেনিং জরুরি।

নিজেকে চেনা জরুরি

শিবায়ন বলছেন, “মেয়েদের নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হওয়া জরুরি। অধিকাংশ মেয়েই মনে করেন ছেলেদের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁরা পেরে উঠবেন না। অথচ নিয়মিত অভ্যেসে একটি মেয়েই কিন্তু একা হাতে চার-পাঁচটি ছেলেকে অনায়াসে কাবু করতে পারেন।” তবে তা রপ্ত করতে দীর্ঘ দিন প্র্যাকটিস করা জরুরি। আবার অনেক অভিভাবকই মনে করেন, মার্শাল আর্টস শিখলে মেয়েদের শারীরিক কোমলতা নষ্ট হয়, চারিত্রিক রুক্ষতা বাড়ে। নাকে, পেটে আঘাত লাগতে পারে, সৌন্দর্য নষ্ট হতে পারে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এ সব ভাবনা বাদ দিতে হবে, বলে মনে করেন শ্রুতি।

আত্মরক্ষায় কী শিখবেন?

কিকবক্সিং: এ ধরনের মার্শাল আর্টস দাঁড়িয়ে লড়াই করার কৌশল শেখায়।

জুজুৎসু: মাটিতে লড়াই করার কৌশল শেখা যায়। এতে আক্রমণকারীকে যেমন মাটিতে ফেলে মারতে পারবেন, তেমনই আক্রমণকারী মাটিতে চেপে ধরলে, নিজেকে রক্ষা করতেও পারবেন।

ফুল কনট্যাক্ট ক্যারাটে: এতে স্টান্স, ব্লক, স্ট্রাইক, পাঞ্চ, কিক… আত্মরক্ষার্থে নানা কৌশল শেখানো হয়। এর মধ্যে প্রতিপক্ষকে ব্লক করতে শেখা জরুরি। যতক্ষণ আক্রমণকারীকে আটকে রাখতে পারবেন, তত দ্রুত সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তাকে ঘায়েল করা সহজ হবে। ক্যারাটেতে স্ট্রেট পাঞ্চ, আপার কাট, নাইফ হ্যান্ড, স্পেয়ার হ্যান্ড, এলবো স্ট্রাইক, ব্যাক ফিস্ট... কয়েক রকমের পাঞ্চ রয়েছে। সঙ্গে ফ্রন্ট স্ন্যাপ কিক, সাইড স্ন্যাপ কিক, সাইড ট্রাস্ট কিক, ব্যাক ট্রাস্ট কিক, রাউন্ড কিক এই পাঁচ ধরনের বেসিক কিক শেখানো হয়। একইসঙ্গে ফুল কনট্যাক্ট ক্যারাটেতে পেট, থাই, কাফ মাসলে হালকা করে মারতে মারতে, আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ানো হয়। শিবায়ন বলছেন, “বিপদে পড়লে আপনাকে মার খেতেই হবে। সেখান থেকে কী ভাবে বেরিয়ে আসতে পারবেন, সেটাই ক্যারাটে শেখায়।”

ফিলিপিনো মার্শাল আর্টস: ব্যাগ, ছাতা, জলের বোতল, চাবির রিং, বালতি, চিরুনি... যা জিনিস হাতের কাছে আছে, তাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার শিক্ষা দেওয়া হয় এই মার্শাল আর্টসে।

বিপদে পড়লে...

আঙুল, মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাতের তালু, কনুই, হাঁটু, পা ব্যবহার করে সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণকারীর চোখ, নাক, গলা, নাক ও ঠোঁটের মাঝের অংশ, পেটের নীচে, কুঁচকি, যৌনাঙ্গ, হাঁটু এবং পায়ের পাতায় আঘাত করুন। এতে আক্রমণকারী দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়বে। সঙ্গে নিজের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আক্রমণকারী হাত ধরে রাখলে: পেটে, বুকে বা যৌনাঙ্গে পা দিয়ে জোরে মারুন। ঘাড় ও কাঁধ ঘুরিয়ে হাতের মুঠি ছাড়ানোর চেষ্টা করুন।

গলা টিপে ধরলে: আক্রমণকারীর কবজি ধরে বিপরীত দিকে হ্যাঁচকা টান দিন। আপনার দুই হাত আক্রমণকারীর হাতের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দুই পাশে ধাক্কা দিতে পারেন। পেটে বা দু’পায়ের মাঝে হাঁটু দিয়ে আঘাত করুন।

চুল টেনে ধরলে: প্রথমে আক্রমণকারীর হাত ধরে রাখুন যাতে চুলে টান আরও বেশি না পড়ে। এর পর আক্রমণকারীর মুখ বা পেটে জোরে কনুই বা হাঁটু দিয়ে আঘাত করুন।

পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলে: আক্রমণকারীর পেটে বা কোমরে আঘাত করুন, এতে তার ভারসাম্য নষ্ট হবে। হাত দিয়ে ঘাড় নীচের দিকে টেনে ধরে চোখে, মুখে ঘুষি মারতে পারেন। পায়ে হিল থাকলে আক্রমণকারীর পা মাড়িয়ে দিন। একাধিক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করুন তার পায়ের আঙুল ও পাতা।

মার্শাল আর্টস যে শুধু বিপদে পড়লে আক্রমণকারীকে পাল্টা আঘাত করতে শেখায় তা নয়, পালানোর ঠিক সময় কোনটা, তা-ও বুঝতে শেখায়। তা ছাড়া নিয়মিত এ অভ্যেসে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তেমনই ফ্লেক্সিবিলিটি, স্টেবিলিটি, ব্যালান্স, মাসকুলার এনডিয়োরেন্স, মাসকুলার স্ট্রেংথ... সবই বাড়বে, ভয় কমবে। শ্রুতি বলছেন, “এই ভয় কমানোটাই সবেচেয়ে জরুরি। অধিকাংশ সময়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে মেয়েরা দিশা হারিয়ে ফেলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পরিস্থিতিকে ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করে পদক্ষেপ করার শিক্ষা দেওয়া হয় মার্শাল আর্টসে। নিয়মিত এর অভ্যেসে মন শান্ত হয়, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে।”

খেয়াল রাখুন

আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করার পাশাপাশি কিছু সতর্কতা মেনে চলুন:

অ্যাপ ক্যাব বা ট্যাক্সিতে উঠলে লোকেশন ও অন্যান্য তথ্য পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে শেয়ার করে রাখুন। অ্যাপ ক্যাবেরও নিজস্ব সুরক্ষাবিধি থাকে। তা হাতের কাছে রাখুন।

ট্যাক্সি বা গাড়ির দরজার কাছে বসুন। জানালার কাচ ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, তা খোলাই রাখুন।

স্পিড ডায়ালে পুলিশের হেল্পলাইন নম্বর এবং সেফ কনট্যাক্ট রাখুন।

নিজের ফোনে ট্র্যাকার অ্যাপ ডাউনলোড করে রাখুন। ব্যাগেও ট্র্যাকার রাখতে পারেন।

বিপদে পড়ে আত্মরক্ষার পরে দ্রুত পুলিশে অভিযোগ করা জরুরি। সেফটি গ্যাজেটস ব্যবহার করার আগে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তা ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে কি না, জেনে নিন। মার্শাল আর্টস বা সেফটি গ্যাজেটের ব্যবহার শুধু শিখলেই হবে না, দরকার নিয়মিত প্র্যাকটিসও। দিনের পর দিন অনুশীলন করলে তবেই বিপদের সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। নয়তো বিপদে পড়ে, ঠিক কোন টেকনিকের ব্যবহার করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই সময় পেরিয়ে যাবে। অসংখ্য টেকনিক শেখার চেয়েও জরুরি, অল্প কয়েকটি টেকনিক শেখা এবং তা নিয়মিত অনুশীলন করা। এতে পদক্ষেপ নির্ভুল হবে, ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসী হবেন এবং পাল্টা আঘাত জোরালো হবে।

মডেল: মৌমিতা সরকার, রোহন মেহরা;

ছবি: শুভজিৎ শীল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement