হাইড্রো অক্সি-ক্লোরো-কুইনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তালিকাও খুব লম্বা।
অবশেষে কি স্বস্তির শ্বাস ফেলা যাবে?
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে করোনা মোকাবিলায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে হাইড্রো অক্সি-ক্লোরো-কুইন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। প্রথম দিন দিনে দুটো করে ও তার পর সপ্তাহে একটা করে সাত সপ্তাহ ধরে ডোজ মেনে খেতে হবে এই ওষুধ। যেমন ম্যালেরিয়া ঠেকাতে, বিশেষ করে জঙ্গলে যাওয়ার আগে অনেকেই এই ওষুধ খান, ঠিক তেমনই।
তবে কোন কোন ক্ষেত্রে? সকলেই কি এই ওষুধ খাবেন? না খাওয়া উচিত?
আইসিএমআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল বলরাম ভার্গব বলছেন, “আপামর জনগণ নয়, খাবেন শুধু সেই সব মানুষ যাঁরা সরাসরি করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন, কিন্তু এখনও রোগের উপসর্গ দেখা দেয়নি। যেমন, করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন এমন ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য সেবাকর্মী এবং কেয়ার গিভার, অর্থাৎ হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীর সেবা করছেন যিনি। তবে তাঁদের বয়স হতে হবে ১৫-র বেশি এবং হার্টের কোনও সমস্যা নেই। তা-ও নিজের বুদ্ধিতে নয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো এই ওষুধ খেতে হবে।”
আরও পড়ুন: প্লাস্টিক, কাগজ, স্টিল… কোন জিনিসে কতদিন বাঁচে করোনাভাইরাস? জেনে নিন
এখানে প্রশ্ন আসবে, এই ১৩০ কোটির দেশে, কোথায় কোন রোগী লুকিয়ে আছে তা কি জানা আছে! জেনে বা না-জেনে তাঁদের সংস্পর্শে অনেকেই আসছেন। তাঁদেরও তো তা হলে এই ওষুধ দরকার। এই মনোভাবের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ওষুধের কালোবাজারি। সরকার থেকে জানানো হয়েছে, প্রেশক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কেনাবেচা করলে শাস্তি হবে। তাতেও ছাড় নেই।
কতটা ভুল? পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী?
আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ-এর অধিকর্তা অ্যান্টনি ফৌচি একেবারেই এই ওষুধ সুস্থ মানুষকে দেওয়ার পক্শপাতী নন, সংশয় আছে আক্রন্তদের বেলাতেও । ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, “কোভিড-১৯ ঠেকাতে কাজে লাগে জানা গেলেও যত ক্ষণ না কনট্রোলড ক্লিনিকাল ট্রায়াল করা হচ্ছে, নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না এই ওষুধ কতটা কার্যকর।”
বিশিষ্ট বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্তের অভিমত, “এ ভাবে দলে দলে ওষুধ কিনে খাওয়াটা একেবারেই কোনও কাজের কথা নয়। কারণ ওষুধ কতটা কাজ করবে তা আমরা নিজেরাই জানি না। কনট্রোলড ক্লিনিকাল ট্রায়াল না হলে তা জানা সম্ভবও নয়। বহু ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার পরেও রোগ হয়। তার উপর হাজারে বা ১০ হাজারে এক জনের কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া নামে হৃদরোগের আশঙ্কা থাকে। বেশ কিছু সমস্যা, যেমন সোরিয়াসিস, পরফাইরিয়া, লিভারের অসুখ, অ্যালকোহলিজম ইত্যাদি থাকলে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বড় ক্ষতি হতে পারে। ওষুধের নিজস্ব সাইড এফেক্টও আছে বিস্তর।’’
করোনা থেকে বাঁচতে নিজে নিজে ওষুধ নয়, বরং নিয়ম মেনে হাত ধুতে থাকুন।
এরই পাশাপাশি সুমিতবাবুর বক্তব্য, ‘‘সবচেয়ে বড় কথা, নিয়ম মানলেই, একটু ঘরে থাকলেই যাঁরা রোগ ঠেকাতে পারেন, তাঁরা যদি এ ভাবে ওষুধটা নিঃশেষ করে দেন, যাঁদের বিপদ সবচেয়ে বেশি, সেই চিকিৎসক-নার্সরা, যাঁদের ঘরে থাকার উপায় নেই, প্রয়োজনে তাঁরা তবে কী খাবেন! নার্সরা দলে দলে আক্রান্ত হলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা কী ভাবে ভেঙে পড়বে তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন! তখন আমার-আপনার চিকিৎসা কী ভাবে হবে!”
আরও পড়ুন: করোনা-যুদ্ধে সাবানের চেয়ে স্যানিটাইজার কি বেশি প্রয়োজনীয়?
এই হাইড্রো অক্সি-ক্লোরো-কুইন গ্রুপের ওষুধের চরিত্র মানেই ম্যালেরিয়ার ওষুধের চরিত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-এর নির্ধারিত সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় ম্যালেরিয়ার কুইনাইন নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকার কারণেই ‘নিরাপদ’ হিসেবে ‘হু’ গণ্য করে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, ‘‘মঙ্গলবারই অ্যারিজোনায় এক ব্যক্তি এই ভাবে নিজেই এই ওষুধ খেতে শুরু করেছিল বলে তাঁর মৃত্যুও হয়েছে। করোনা না হয়েই করোনা ঠেকানোর ভুল চেষ্টায় তাঁর মৃত্যু হল। এই হাইড্রো অক্সি গ্রুপের ওষুধ আসলে ব্যবহৃত হয় রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কোনও কোনও জটিল ক্ষেত্রে। মুড়িমুড়কির মতো নিজের ইচ্ছে মতো এই ওষুধ খেলে বিপদ বাড়বেই।’’
সমস্যা আছে আরও। অনেকে ওষুধের খবর পেয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, নিয়ম মানার আর কোনও দরকার নেই। ফলে ওষুধ যদি রোগ ঠেকাতে না পারে, যাঁর আশঙ্কা খুবই বেশি, অনিয়ম করার দরুণ রোগ হওয়ার আশঙ্কা তাঁর বেলায় অনেক বেড়ে যাবে। তখন কী করবেন?
তা হলে কী করব?
বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, মাথা ঠান্ডা করে ভাল-মন্দ সব কিছু ভেবে দেখুন। আতঙ্কের বশবর্তী হয়ে শুধু শুধু ওষুধ খাবেন না। হাত ধোওয়ার নিয়ম মানুন, একেবারে বাইরে বেরবেন না। ঘরে থাকুন। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলুন।