Blue Rays

নীল আলোর ফলে...

দিনভর গ্যাজেট ব্যবহারে শরীরে পড়ে নীল আলোর প্রভাব। তার থেকে যে কোনও বয়সেই দেখা দিতে পারে সমস্যা। সতর্ক থাকবেন কী ভাবে?

Advertisement

কোয়েনা দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪ ০৫:১৩
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

বছর দুয়েকের পিকুকে চারবেলাই মোবাইল দেখিয়ে খাওয়ায় তার মা। তাতে নাকি দুষ্টুমি কম করে পিকু। ক্লাস সেভেনের মিষ্টির হাতে আবার সারাক্ষণ মোবাইল। কখনও গেমস তো কখনও অনলাইন টিউশন। অবসরের পর টুকটাক সাহিত্য চর্চা করেন আদিত্য। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাতা-কলমের বদলে এখন আই-প্যাডেই বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি। এ দিকে চাকরির খাতিরে দিনে প্রায় বারো ঘণ্টারও বেশি কম্পিউটারে চোখ রেখে সময় কাটে আকাশের।

Advertisement

দিনের অধিকাংশ সময়টাই গ্যাজেটের দিকে তাকিয়ে কাটান অনেকে। কেউ কাজের খাতিরে, কেউ বা নেহাত সময় কাটাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিভি, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, কম্পিউটার মনিটর ইত্যাদি থেকে নির্গত হয় এক ধরনের নীল আলো বা ব্লু রে, যার প্রভাব সরাসরি শরীরে পড়ে। অতিবেগুনি রশ্মির মতোই এই ব্লু রে-র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম। ফলে চোখের বিভিন্ন কোষগুলি সহজে সেই আলো শুষে নেয়। এতে ক্ষতি হয় চোখের কোষের।

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সমস্যা কী হয়?

Advertisement
  • চোখের ক্ষতি: চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. দেবার্পিতা চৌধুরী বলছেন, “এর ফলে চোখে এক ধরনের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি হয়। অত্যধিক ব্লিচ ব্যবহারে ত্বকের উপরে যেমন প্রভাব পড়ে, চোখের ক্ষেত্রেও নীল আলোর প্রভাব তেমনই হয়। কর্নিয়া, লেন্স, রেটিনা তিনটির উপরেই ব্লু লাইটের প্রভাব পড়ে। বয়স বৃদ্ধি, ডায়াবিটিস ইত্যাদি নানা কারণে চোখের জ্যোতি এমনিই কমতে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ব্লু রে শোষণে চোখের লেন্সে থাকা প্রোটিন শুকিয়ে যায়। ফলে এই ডিজেনারেশন শুরু হয় তাড়াতাড়ি। দ্রুত বাড়ে চোখের পাওয়ার, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ড্রাই আইজ়, ছানি ইত্যাদির সমস্যা।
  • ঘুমের ক্ষতি: নিউরোলজিস্ট ডা. হাসিব হাসান বলছেন, ‘‘নীল আলোর কারণে রাতের বেলায় শরীরে মেলাটোনিন হরমোন ক্ষরণ কম হয়। তা থেকে ঘুমের ব্যাঘাত, ইনসমনিয়ার মতো সমস্যা হয়। সঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে অবসাদ, অ্যাংজ়াইটি ডিসঅর্ডার, স্মৃতিশক্তির সমস্যা ইত্যাদিও হতে পারে।
  • ত্বকের ক্ষতি: সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির মতোই নীল আলোর সংস্পর্শেও ত্বকের ক্ষতি হয়। এই ব্লু রে ত্বকের উপরিভাগ দুর্বল করে কোলাজেনের গঠন ভেঙে ফেলে। ফলে অল্প বয়সেই ত্বকে পড়তে পারে বলিরেখা।
  • সঙ্গে রয়েছে খিদে কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা, মাথা যন্ত্রণার মতো আনুষঙ্গিক সমস্যাও।

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ব্যতিক্রমও আছে

চোখ, ত্বকের ক্ষতি হলেও, এই নীল আলো কিছু ক্ষেত্রে সুবিধেও দেয়। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বলছেন, “বইয়ের সাদা কালো একঘেয়ে অক্ষর ক্লান্তি বাড়ায়। কিন্তু ব্লু রে থেকে ডোপামিন অর্থাৎ হ্যাপি হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে, যা শরীর ও মন চাঙ্গা রাখে। আর সে কারণেই কাগজে ছাপানো অক্ষরের বদলে গ্যাজেটের মাধ্যমে কিছু পড়লে তা সহজে মনে থাকে।” তা ছাড়া, হ্যাপি হরমোনের কারণে অবসাদ কেটে যায়, মন ভাল হয়। ডা. দেবার্পিতার কথায়, “সারা দিনে দু’ঘণ্টা (তার বেশি নয়) মোবাইল, টিভি ইত্যাদি দেখা কিন্তু চোখের পক্ষেও ভাল। এতে দূরের পাওয়ার বাড়ার সম্ভাবনা কমে।”

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ব্লু রে আই গ্লাস

ডিজিটাল আই স্ট্রেন কমাতে চশমায় বিশেষ ধরনের ব্লু লাইট প্রোটেক্টর গ্লাস ব্যবহার করেন অনেকে। ডা. মণ্ডল সতর্ক করছেন, কেবল ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহারের সময়েই কিন্তু সেই চশমা ব্যবহার করবেন। সাধারণ পড়াশোনা, খেলাধুলো, গাড়ি চালানো, অন্যান্য কাজের সময়ে এই লেন্স ব্যবহার করা চোখের পক্ষে ভাল নয়। দেবার্পিতার কথায়, “ব্লু রে আই গ্লাস যে খুব কার্যকর এমনটা প্রমাণিত নয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই গ্লাস ব্যবহার না করাই ভাল। তবে এতে ক্ষতির কিছু নেই। বড়রা চাইলে এ ধরনের গ্লাস ব্যবহার করতেই পারেন।”

তবে উপায়?

ছোটখাটো কিছু ভাল দিক থাকলেও, নীল আলোর কারণে চোখের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। গ্যাজেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা মেনে চলা জরুরি।

  • সারা দিনে গ্যাজেট ব্যবহারের সময় বেঁধে নিন।
  • ‘২০, ২০, ২০ রুল’ মেনে চলুন। অর্থাৎ একটানা ২০ মিনিট টিভি, মোবাইল, কম্পিউটার দেখার পর ২০ মিটার দূরের কোনও জিনিসের দিকে ২০ সেকেন্ড ধরে তাকিয়ে থাকুন। এতে চোখ কাছের ও দূরের দৃশ্য দেখার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাবে। পরবর্তী সময়ে দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হবে না। এমনকি এর ফলে পাওয়ার বাড়ার আশঙ্কাও কমবে।
  • মোবাইল, কম্পিউটার যতটা সম্ভব দূর থেকে ব্যবহার করুন। ল্যাপটপের বদলে ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করলে ভাল।
  • কাজ শেষে অন্তত আধ ঘণ্টা বিশ্রাম নিন। গ্যাজেট থেকে দূরে থাকুন। তার পর ঘুমোতে যান। এতে ঘুম ভাল হবে। চোখ বিশ্রাম পাবে।
  • ডিজিটাল আই স্ট্রেন কমাতে গ্যাজেটের স্ক্রিনে লাগান ব্লু রে ফিল্টার। সব ডিভাইসেই এখন রিডিং মোড, নাইট মোড ইত্যাদি থাকে। তা অন করে রাখুন। এই মোডে স্ক্রিন থেকে নীল আলো কম পরিমাণে বেরোয়। ফলে চোখে চাপ পড়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমবে।
  • যতটা সম্ভব সাদা স্ক্রিন কম ব্যবহার করুন। কম্পিউটারে ওয়ার্ড বা যে কোনও সাদা উইন্ডোর বদলে রঙিন পেজ ব্যবহার করুন। এতে ব্লু লাইট কম নিঃসরণ হয়।

নজরে ঘরের আলো

ঘরে লাগানো ঝকঝকে সাদা এলইডি লাইট থেকেও নির্গত হয় এ ধরনের নীল আলো। দীর্ঘ কাল যার ব্যবহারে ক্ষতি হয় চোখের। বরং ঘরে লাগানো যেতে পারে নরম হলুদ আলো বা ওয়ার্ম লাইট। এতে ঘর যেমন সুন্দর দেখাবে, ক্ষতিও কম হবে। বাচ্চার পড়ার ঘরে আলো লাগানোর সময়েও খোঁজখবর করুন।

মেনে চলুন কিছু নিয়ম

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এখন প্রযুক্তি ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। তাই সুস্থ থাকতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে নিজেদেরই।

  • অন্ধকার ঘরে মোবাইল, টিভি বা কম্পিউটার ব্যবহার একেবারেই নয়।
  • শুয়ে মোবাইল বা ট্যাবলেট ব্যবহার করবেন না।
  • একটানা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে না থেকে ২০-৩০ মিনিট পরপর খানিক বিশ্রাম নিন।
  • ছোট স্ক্রিন যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। বাচ্চাকে মোবাইলের বদলে টিভি চালিয়ে দিন। কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপেও যতটা সম্ভব বড় স্ক্রিন ব্যবহার করুন।

কথায় আছে, ‘মর্নিং শোজ় দ্য ডে’। কিন্তু আপনার সকাল কেমন হবে, তা স্থির করে দেবে রাতটা কেমন কেটেছে। তাই ঘুমের আগে মোবাইল নয় এবং শরীর থেকে বেশ দূরেই রাখুন যন্ত্রটি। সব রকম সতর্কতা অবলম্বন সত্ত্বেও যদি মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালা, জল পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়, তবে দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

মডেল: ঐশিকী বসু

ছবি: অমিত দাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement