প্রতীকী চিত্র
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে পড়ে? হিন্দি ছবি ‘পিকু’তে অমিতাভ বচ্চনের অভিনীত চরিত্র ছিল সেটি। দিল্লি থেকে কলকাতায় ফেরার সময়ে গাড়ির মাথায় চেয়ার চাপিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। কারণ বাওয়েল মুভমেন্ট সমস্যায় ভুগত ভাস্কর। ভাস্করের চরিত্রায়নের সঙ্গেই ছবির পরিচালক তুলে ধরেছিলেন এমন সমস্যার কথা, যাতে ভোগেন বহু মানুষ। বাঙালির আজন্ম ঝাল-ঝোল-অম্বলের খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করা হলেও বাওয়েল মুভমেন্টের সমস্যা কিন্তু শুধু বাঙালির নয়। এমনকি এই রোগ শুধু মাত্র বিশেষ কোনও বয়সের পরেও শুরু হয় না। খুঁজলেই দেখা যাবে যে, আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের শিকার অনেকেই। পাশাপাশি রয়েছে এটি নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণাও। আইবিএস কী? কেমন হয় তার প্রতিকার?
আইবিএস কী?
সাধারণত কেটে-ছড়ে-পুড়ে যাওয়া, কিডনির সমস্যা, হৃদ্যন্ত্র বিকল কিংবা পেটের ক্রনিক কোনও সমস্যা থাকলে তার ফিজ়িক্যাল বা শারীরবৃত্তীয় বদল ঘটে। কিন্তু আইবিএসের ক্ষেত্রে তেমন কোনও বদল হয় না। অর্থাৎ ইনটেস্টাইন বা অন্ত্রের দেওয়ালে কোনও ক্ষত বা পেটের কোথাও কোনও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হয় না। টিউমর বা গ্রোথের মতো সমস্যাও নেই। আইবিএসে তাই গঠনগত সমস্যা নয়, ফাংশনাল ডিজ়অর্ডার হয়। তার জন্যই কোনও ডাক্তারি পরীক্ষা করে ধরা পড়ে না আইবিএস। রক্ত পরীক্ষা, পেটের আলট্রাসোনোগ্রাফি, কোলোনোস্কোপি, সিটি স্ক্যান সবেতেই রিপোর্ট আসবে স্বাভাবিক।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, ‘‘খাদ্যনালী, নার্ভ-সহ সার্বিক ভাবে গোটা শরীরের সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। সেখান থেকেই সিগনাল আসে ও তার ফলে বাওয়েল মুভমেন্ট হয় দ্রুত। তার পরেই আসে মলত্যাগের বেগ। কিন্তু এই সিগনালিংয়েই ফাংশনাল সমস্যা থাকলে তৈরি হয় আইবিএস।’’
সমস্যার দোরগোড়ায়
যেহেতু নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি মস্তিষ্কের হাতে, ফলে দিনে কত বার বাথরুমে যেতে হবে, সেই সিগনালিংয়েও ভূমিকা মস্তিষ্কেরই। কিন্তু মস্তিষ্ক আবার চালিত হয় দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস, ভয়, আতঙ্ক ইত্যাদি অনুভূতি দ্বারা। তাই প্রায়শই দেখা যায় পরীক্ষার আগে টেনশনে বারবার বাথরুমে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।
আয়ুর্বেদের ভাষায় আবার আইবিএসের নাম গ্রহণী। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ডা. শিখা প্রকাশ বলছেন, ‘‘অনিয়মিত খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত মদ্যপান, ব্যায়ামের ঠিক পরেই খাবার খাওয়া, এমনকি অতিরিক্ত ব্যায়ামও কখনও কখনও আইবিএসের সমস্যা ডেকে আনতে পারে।’’ আসলে জীবনযাপনের অভ্যেস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ছাপ ফেলে মস্তিষ্কে। ফলে স্বাভাবিক ভাবে আইবিএস জুড়ে যায় মস্তিষ্কের সিগনালিংয়ের সঙ্গে।
বাওয়েল বা খাদ্যনালীর ইরিটেশনকে চিকিৎসকেরা কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। কখনও খুব বেশি র্যাপিড সিগনালিং হয়। অর্থাৎ কোনও সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ যদি দিনে এক বা দু’বার মলত্যাগ করেন, আইবিএস আক্রান্তকে তখন যেতে হয় দিনে আট-দশ বার, কখনও বা তারও বেশি। ডায়রিয়ার ধরনের কথা মাথায় রেখে একে বলা হয় আইবিএস ডি। অাবার কারও যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা থাকে, তা হলে তিনি সাধারণত তিন-চার দিনে এক বার যান। কনস্টিপেশনের ধারণা থেকে এই রোগকে বলা হয় আইবিএস সি। এমন মানুষও আছেন, যাঁরা মাসের ১৫ দিন আইবিএস সি ও বাকি ১৫ দিন আইবিএস ডি-এর সমস্যায় ভোগেন। এই সমস্যা চিকিৎসকদের ভাষায় মিক্সড ভ্যারাইটি।
লক্ষণ
আইবিএসে সাধারণত পেটে ব্যথা থাকবেই। সারা পেট জুড়ে কামড়ে ধরা ও মোচড় মারা ব্যথাই এর প্রধান লক্ষণ। নাভির নীচ থেকে বাঁ দিক চেপে কুঁকড়ে যাওয়া ব্যথাও এর আওতায় পড়ে। বেগ বাড়লে সিগনালিংয়ের চোটে নার্ভ পর্যন্ত ফেলিয়োর হয়। হাত-পা ঠান্ডাও হয়ে যেতে পারে। আবার মলত্যাগ করলেই ব্যথার নিরসন হলে বুঝতে হবে আইবিএস। তবে বারবার বাথরুমে গেলেও প্রত্যেক বার যে মলের পরিমাণ বেশি হবে, তা কিন্তু নয়। আবার মলের ধরন সাধারণত সান্দ্র্য, ঘোলাটে বা তরল হতে পারে। তবে মলের সঙ্গে রক্ত বেরোয় না এবং শরীরে জ্বরভাবও থাকে না। অন্য দিকে আইবিএস সি-র রোগীদের ক্ষেত্রে গ্যাস, পেটের উপরে চাপ, অস্বস্তি, বারবার ঢেঁকুর তোলার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
ডা. তালুকদার বলছেন, ‘‘সাধারণত কমবয়সি অর্থাৎ ৪৫ বছরের নীচে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা আইবিএসে ভোগেন। তবে তার মানে এই নয় যে, ষাটোর্ধ্ব কারও এই সমস্যা হবে না। সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এই সমস্যা ব্যক্তিটির আগে থেকেই ছিল। ষাট পেরোনোর পরে প্রথম বার আইবিএসে ভোগার সমস্যা সাধারণত কম হয়। ষাটোর্ধ্ব কেউ আইবিএসের সমস্যা নিয়ে এলে প্রথমেই অন্য পরীক্ষা করে দেখা হয় তাঁর জ্বর, খাদ্যনালীতে ইনফেকশন, টিউমর বা অন্যান্য সমস্যা আছে কি না।’’
সমাধান সূত্র
চিকিৎসকদের মতে, বিশেষ কোনও চিকিৎসা আইবিএসের হয় না। বরং স্ট্রেসের গোড়া নির্মূল করা বা রিলিফ করার বন্দোবস্ত করা দরকার। কী কারণে, কখন রোগীর স্ট্রেস বাড়ে, সেটা আগে নির্ণয় করতে হয়। কারণ সাইকোলজিক্যাল সমস্যা দূর করলে আইবিএসকেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং, ওষুধপত্রও দিতে হতে পারে। কিন্তু হতেই পারে যে, কাউন্সেলিং করেও দুশ্চিন্তা, টেনশন, স্ট্রেস কমল না। সে ক্ষেত্রে আইবিএসের ধরন বুঝে মেডিসিনের চিকিৎসকেরা ওষুধ দেন। ডি টাইপের ক্ষেত্রে অ্যান্টি স্প্যাজ়মোটিক ওষুধ দেওয়া হয়। এতে মুভমেন্ট কম হয়। পেটে ব্যথাও কমে। আবার ঘনঘন মুভমেন্টও রোধ করা যায়। অন্য দিকে সি টাইপের ক্ষেত্রে উল্টো ওষুধ দিতে হয়, যাতে ব্যক্তিটি রোজ মলত্যাগ করেন। এতে গ্যাস জমে থাকে না, অস্বস্তি দূর হয়। মিক্সড ভ্যারাইটির ক্ষেত্রে দু’ধরনের ওষুধই চলে।
ডা. প্রকাশ বলছেন, ‘‘অ্যাটাকের সময়ে সহজপাচ্য এবং হালকা খাবার খাওয়া দরকার। ডাল, দুধ, গম একেবারেই বাদ। ভেজিটেবিল সুপ, ভাত, তেল-মশলাহীন খাবার খেলে ভাল। পাশাপাশি নেশার দ্রব্যও ত্যাগ করতে হবে।’’ আবার যে খাবার খেলে সমস্যা বাড়ে, সেগুলি চিহ্নিত করে তা-ও বাদ দিতে হবে। কনস্টিপেশনের সমস্যা থাকলে খেতে হবে ফাইবারযুক্ত খাবার। ডায়েট ছাড়াও জীবনযাপনের ধারায় পরিবর্তন আনা দরকার। ব্যায়াম, প্রাণায়াম, হাঁটাহাঁটি ও রোজ ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।
ওষুধ বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আইবিএসের সমস্যা মেটানোর উপায় সাময়িক। এই সমস্যাকে একেবারে নির্মূল করতে সার্বিক ভাবে বদল আনা দরকার জীবনযাপনে। শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক ভাবে ভাল থাকার ইচ্ছেটাও বড্ড জরুরি।