ইউরো ফাইনালে ইংল্যান্ডকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই ডুবিয়েছে, বলছেন পণ্ডিতরা। জেতার আগেই তারা নিজেদের চ্যাম্পিয়ন ভাবছিল। অথচ শুরুতেই গোল খেয়েও দমে যায়নি ইটালি। ম্যাচ পেনাল্টি শুট আউটে টেনে নিয়ে গিয়েছে। কারণ, তারা জানত, টাইব্রেকারে গোলরক্ষক ডোনারুমাই তাদের তুরুপের তাস। জীবনের ময়দানেও এটাই সত্যি। নিজের দক্ষতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও সেই গুণাবলিতে বিশ্বাস রাখা জরুরি। এই আত্মবিশ্বাস বাড়াবাড়ি হলেও মুশকিল, আবার মনের জোর খোয়া গেলেও বিপদ। দুটোর মধ্যে সমতা রেখে, আত্মপ্রত্যয় বজায় রাখতে পারলে জীবনে এগিয়ে চলাও সহজ হবে।
আত্মবিশ্বাস গড়ার কৌশল
সুস্থ আত্মবিশ্বাস গড়তে বিশেষজ্ঞেরা কিছু উপায় বাতলেছেন। যেমন, নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাগুলো লিখুন। পাশেই নিজের সাফল্যগুলো সাজিয়ে দিন। সামর্থ্য, ভাল লাগাগুলিও লিখুন। ‘প্রজেক্টটা তাড়াতাড়ি শেষ করলাম’, ‘আমি ভাল রান্না করি’, ‘বোন প্রায়ই আমাকে ফোন করে’ ইত্যাদি। নিজের সম্পর্কে কুণ্ঠা কেটে যাবে।
নিজের বিষয়ে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিন। এতে তাঁরাও আপনার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবেন। আর অন্যদের সমালোচনাকে গঠনমূলক কাজে লাগালে উপকৃত হবেন। আবার কোনও বিষয়ে অনিচ্ছুক হলে বা তা সাধ্যের বাইরে হলে, ‘না’ বলুন।
আত্মপ্রত্যাশা যেন বাস্তবসম্মত হয়
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ, ‘‘আত্মবিশ্বাসের মধ্যে অনেকটাই তো আত্মমূল্যায়ন। নিজেকে যে ভাবে মূল্যায়ন করে এগোবেন আর কাজের জায়গা বা পরিপার্শ্ব যে ভাবে মূল্যায়ন করবে, তার মধ্যে বারবার সামঞ্জস্যের বড়সড় ঘাটতি তৈরি হলে আত্মবিশ্বাস ঘা খায়। যে ভাবে পরিকল্পনা করে সাফল্য আসবে ভাবা হয়, তা না হলেও এই আঘাত আসে। বহু সময়েই আত্মবিশ্বাসের অভাবের প্রেক্ষিত থাকে। দেখা যায়, কিছু ঘটেছে, যার মাধ্যমে বিশ্বাস নড়েছে। আত্মবিশ্বাস কখনও টাল খাবে না, তা বলা যায় না। আপাত ভাবে আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিরও কখনও মনে হতে পারে যে, ‘ইস! কাজটা পারব ভাবলাম, কিন্তু পারলাম না।’ বুঝতে হবে, প্রত্যেকেই কাজটা যে ভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন, তাতে তিনি যেমন সফল ও প্রশংসিত হতে পারেন, আবার কখনও বিচ্যুতি ঘটতে পারে।’’ আত্মমূল্যায়নের সময়ে মাথায় রাখতে হবে যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আপনি প্রথম হবেন কি না, তা আপনার হাতে নেই। কিন্তু জরুরি হল, কাজটা কতটা প্রস্তুতি ও চেষ্টা নিয়ে করছেন।
অনেক সময়ে ‘ওভার কনফিডেন্স’-এর কারণ হল, বাস্তববর্জিত আত্মমূল্যায়ন এবং নিজের কাছে নিজে প্রমাণ দিতে চাওয়া যে, ‘হ্যাঁ আমি পারব।’ অনেক সময়ে অনেকে অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেন, কার্যক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন না। তখন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বুঝিয়ে বললেন অনুত্তমা।
নিজের সম্পর্কে ঠিক ধারণা থাকা জরুরি
তাঁর কথায়, আগের সাফল্য-ব্যর্থতার মানসিক মানচিত্র এঁকে নিলে, একটা নির্দিষ্ট কাজ শেষ করতে কতটা সময় লাগছে, পরিষ্কার ধারণা থাকবে। সেই অনুসারে বাস্তবসম্মত আত্মপ্রত্যাশা রাখাই বাঞ্ছনীয়। তার নিরিখে, যতটা পূরণ করা সম্ভব, ঠিক ততটাই প্রত্যাশা অন্যের মধ্যে তৈরি করা উচিত। আত্মবিশ্বাস থাকলে যা জানেন না বা পারবেন না, সেটা বলতে আটকায় না। কারণ সুস্থ আত্মবিশ্বাসের অর্থই হল কিছু জিনিস জানা, কিছু বিষয় অজানা বা ‘পারি না’-র তালিকায়। সব পেরে যাওয়ার আত্মপ্রত্যাশা যত রাখবেন, তত এমন কিছু লক্ষ্য স্থির করবেন, যাতে হয়তো
ব্যর্থতা অনিবার্য। সেখানেই আত্মবিশ্বাস ঘাটতির ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়। প্রকারান্তরে তা আত্মবিশ্বাস বা আত্মমূল্যায়নকে আঘাত করে।
নিজেকে মোটিভেট করুন
অতিমারি মানুষের আত্মবিশ্বাসে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। কেউ বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করতে উদ্যম, সৃজনশীলতা পাচ্ছেন না। ছাঁটাইয়ের পরে কারও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। আপনজন হারিয়ে ছন্দে ফেরার শক্তিটুকুও নেই অনেকের। রাস্তায় বেরোনোর ইচ্ছে চলে যাচ্ছে, বাইরের পৃথিবীটায় শঙ্কিত লাগছে— বলছেন কেউ। তবুও তো বেঁচে থাকার লড়াইটা লড়তে হবে, তার জন্য আত্মপ্রত্যয়টুকু জিইয়ে রাখতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘এই সময়ে দারুণ ভাল থাকাটাই অস্বাভাবিক, বাস্তবের থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা। এই বোধটাকে জাগিয়ে রাখতে হবে যে, আমাদের চেয়ে অনেকেই খারাপ আছেন। এর মধ্যেই নিজের পছন্দমতো ভাল থাকার চেষ্টা করতে হবে। ব্যায়াম করুন, অন্যদের সঙ্গে কথা বলুন। স্পষ্ট বলুন, ‘মনটা ভাল নেই।’ একটু আড্ডা দেওয়ার সময় বার করলে ভাল হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কফিও খেয়ে আসতে পারেন।’’
দুঃসময় যোগ্যতার কষ্টিপাথর
‘‘অন্যদের সাহায্য করুন। বয়স্ক আত্মীয়কে সঙ্গ দিন, খেয়াল রাখুন। যে বন্ধু আপনার চেয়েও দুরবস্থায়, হয়তো অতিমারিতে বাবাকে হারিয়েছে, তার দেখাশোনা করুন। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলে কিন্তু নিজেকে নিয়ে ইতিবাচক ধারণাটা পোক্ত হয়। নিজের কাজ যখন ভাল ভাবে হচ্ছে না, সেই অন্ধকার কাটিয়ে ওঠার এটা দারুণ উপায়’’, বলছেন ডা. রাম।
আর একটা বিষয়ও খুব জরুরি— কমফর্ট জ়োন থেকে বেরোনোর আর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার অভ্যেস রাখুন। নতুন কিছু শিখুন বা করুন। ফোটোগ্রাফি বা নতুন ভাষা শিখুন। ব্যায়ামের রুটিন তৈরি করুন। এতে পরিস্থিতি বিচারে নিত্যনতুন উপায়ে নিজের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলার সাহস থাকবে মনে।
অনুত্তমা বলছেন, ‘‘এমনও দেখেছি, ঘাতক দ্বিতীয় তরঙ্গে এক চিকিৎসক নিজের পরিবারের লোককে বাঁচাতে পারলেন না। তা হলে কি তিনি মনে করবেন যে তাঁর ডাক্তারি বৃথা? বুঝতে হবে যে, আমার কি সত্যিই কারওকে বাঁচানোর বা একেবারে ঠিক রাখার পুরো ক্ষমতা আছে? আবারও তো সেই ক্ষমতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যাচ্ছে! চেষ্টা করাই যায়, তার পর অনেক কিছুই অনিশ্চিত থাকে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ক্লান্তি আসবে, বিরতি নিতে চাইবে মন। সব বুঝেশুনেই কাজের ভার নিতে হবে। সংস্থা যদি দেখে, কর্মী যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তার অনেকটাই করে উঠতে পারছে না, তা হলে কিন্তু তারা বিরক্ত হবে এবং কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অতিমারিতে গণছাঁটাই হয়েছে। সেখানে চাকরি যাওয়ার সমস্যাও সে ভাবেই যুঝতে হবে। বুঝতে হবে, এটা পরিস্থিতির জটিলতা, ব্যক্তি-ব্যর্থতা নয়।’’
দুঃসময়, অতিমারির পৃথিবী শুধুই মানুষকে দীর্ণ করছে, তা কিন্তু নয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই তো আমাদের সেরা বুদ্ধি, সেরা রণকৌশলগুলো আপনা হতেই বেরিয়ে আসে। অতিমারিও আমাদের ভিতর থেকে আসল নৈপুণ্যতা, যোগ্যতাকে টান মেরে বার করে আনছে। সেগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। আর, নিজের ক্ষমতা ঠিক ঠিক চিনে রাখাকেই তো বিশেষজ্ঞরা আত্মবিশ্বাস বলছেন, তাই না?
মডেল: আয়ুষী তালুকদার, উদিতা মুনশি
ছবি: শুভদীপ সামন্ত
মেকআপ: চয়ন রায়
পোশাক: ইমেজ অ্যান্ড স্টাইল, গড়িয়াহাট (আয়ুষী)
লোকেশন: ক্লাব ভর্দে ভিস্তা