— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই হরেক ফুড ব্লগিং আর চটজলদি রেসিপির ভিডিয়ো। দেখতে দেখতে ফ্রিজ খুলে খাবারের সন্ধান। কিংবা মাঝরাতে ঘুম না আসায় টুকটাক খাবার মুখে চালান করা। এমন অভ্যেস আমাদের আশপাশে কমবেশি অনেকেরই রয়েছে। অন্যকে খেতে দেখলে খিদে পেয়ে যাওয়া, মন খারাপ থাকলে বেশি করে খাওয়া... অর্থাৎ খিদে না থাকা সত্ত্বেও খাওয়ার ইচ্ছে জাগার নামই ইমোশনাল ইটিং। সহজ কথায় যাকে চোখের খিদে বলে থাকি আমরা। এটি ইটিং ডিসঅর্ডার না হলেও এই অভ্যেস কাউকে ঠেলে দিতে পারে ডিসঅর্ডারের দিকে। ওবেসিটির চোখরাঙানি তো আছেই, পাশাপাশি ইমোশনাল ইটিং থেকে জন্ম নিতে পারে অপরাধবোধও... মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে এটি সরাসরি সম্পর্কিত। তাই এই অভ্যেস থেকে বেরোতে গেলে প্রথমেই চিহ্নিত করতে হবে সমস্যাটি।
শনাক্তকরণ
সত্যিই খিদে পেয়েছে, না স্রেফ অভ্যেসের বশে খাচ্ছেন— প্রথমেই তা বুঝতে হবে নিজেকে। এই বুঝতে পারার কাজটি সহজ নয়। প্রথমেই ভেবে দেখুন, অবসাদ, দুঃখ, ক্লান্তি, একাকিত্ব, একঘেয়েমি, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ রয়েছে, এমন সময়ে খেতে ইচ্ছে করছে কি না। ‘ট্রিগার পয়েন্ট’ চিহ্নিত করতে পারলেই কাজটা সহজ হয়ে যাবে। পছন্দসই খাবার পেলেই মনটা ভাল হয়ে যাবে, এমন চিন্তা মাথায় এলে সংযত হোন। পছন্দের খাবার খাওয়ার পরে ডোপামিনের ক্ষরণ সাময়িক ভাবে আনন্দের অনুভূতি জাগায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ সময়ে হাতের কাছে থাকা চটজলদি খাবার বা বাইরের খাবার বেছে নেন অনেকে। ফলে অজান্তেই গড়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যেস। তবে এতে আসল সমস্যা আড়ালেই রয়ে যায়। তার সমাধান না পেয়ে বিকল্প ‘রিলিফ’ হিসেবেই তখন কাজ করে খাওয়ার অভ্যেসটি।
মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায় বললেন, খাওয়া যখন ‘অবসেশন’-এর পর্যায়ে চলে যায়, তখন অন্যান্য মনের অসুখের মতো এরও চিকিৎসা প্রয়োজন বইকি। আর এ জন্য সাইকোথেরাপিতেই কাজ হয় সাধারণত। তবে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেলে তখন ওষুধের প্রয়োজনও হতে পারে বলে জানালেন তিনি। ‘‘এ ক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির ভূমিকা রয়েছে। খাবারাদাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি করার নেপথ্য কারণ বা ‘ট্রিগার’টা কিন্তু আসলে মানসিক। তবে ট্রিটমেন্ট শুরু হলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এই অভ্যেস,’’ জানালেন তিনি।
— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সত্যিকারের খিদে নয়তো?
সারাদিনে নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাওয়ার অভ্যেস থাকলে ঠিক সেই সময়েই শরীর জানান দেবে। আর তা না হলে অসময়ে, বিশেষ কোনও খাবারের ‘ক্রেভিং’ হলে বুঝতে হবে শরীর নয়, খাবার চাইছে মন। ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নফিস জানালেন, ফিজ়িক্যাল ইটিং আর কমফর্ট ইটিংয়ের মধ্যে তফাত বোঝার সবচেয়ে ভাল উপায় হল, যখন-তখন কোনও নির্দিষ্ট খাবারের জন্য উতলা হচ্ছেন কি না, তা লক্ষ রাখা। ‘‘এ রকম সময়ে এক গ্লাস জল খেয়ে দেখুন। যদি তার পরেও খিদে পায়, তা হলে বুঝবেন সত্যি খিদে পেয়েছে। না হলে এই ধরনের ক্রেভিং হলে হাতের কাছে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক অপশন রাখতে হবে। ক্রিম বিস্কিট, ভুজিয়ার বদলে একটা ফল কিংবা শসা খেলে উপকৃত হবেন। খাবার ইচ্ছে প্রশমিত হবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যও বজায় থাকবে,’’ পরামর্শ হিনার।
স্বাস্থ্যকর বিকল্প
সমস্যা শনাক্ত করার পরের ধাপ হল, ধীরে ধীরে তা থেকে বেরিয়ে আসা। টিভি দেখতে দেখতে বা বই পড়তে পড়তে মুখ চালানোর অভ্যেস বন্ধ করতে হবে। অনেকে রাত জেগে কাজ করার সময়ে হাতের কাছে খাবার নিয়ে বসেন। বেশির ভাগ সময়েই সে সব মুখরোচক খাবার হয়, স্বাস্থ্যকর নয়। হিনার কথায়, “ছোলা, গুড় বাদাম, ড্রাই ফ্রুটস, খেজুর বা মাখানার মতো খাবার হাতের কাছে রাখতে হবে। মুখ চালানোর অভ্যেস এক দিনে ছাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অভ্যেস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনেকে রাতে ফল খেতে ভয় পান। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কায়। কিন্তু কেক, পেস্ট্রি, বিস্কিটের চেয়ে একটা ফল খাওয়া বেশি উপকারী,’’ বললেন হিনা।
— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
খাওয়া যখন অভ্যেস
অনেকে সন্ধেবেলা ডিনার করে নেন, অথচ ঘুমোতে যান দেরি করে। তাড়াতাড়ি ডিনার করার অভ্যেস ভাল হলেও ইমপ্র্যাকটিক্যাল, মনে করেন হিনা। ‘‘সন্ধে ৭টার মধ্যে ডিনার করে রাত ১২টারও পরে ঘুমোতে গেলে খিদে পেয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এখনকার বাচ্চারাও অনেক দেরি করে ঘুমোতে যায়। সে ক্ষেত্রে শুতে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক বা ঘণ্টাদুয়েক আগে ডিনার করাই সমীচীন,’’ বললেন হিনা। দুধ, পেস্তা, বাদাম জাতীয় খাবার ঘুমোতে যাওয়ার আগে খেলে তা মেলাটোনিনের ক্ষরণে সহায়ক।
সারা দিন কম খেয়ে এক বারে অনেকটা খাওয়ার অভ্যেস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাবার অভ্যেস তৈরি করতে হবে। চোখের খিদে নিয়ন্ত্রণ করার পরোক্ষ উপায় এক্সারসাইজ় ও মেডিটেশন। অনেকে সবটা মেনে চললেও মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। মিষ্টি খান, তবে যথেচ্ছ নয়। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললেই আপনা থেকেই কমে যাবে চোখের খিদে।