Relationship

Gender Roles: সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে, কিন্তু দুই সমকামী পুরুষের সংসারে সুখের দায়িত্ব কার!

দুই পুরুষ একসঙ্গে বাস করলে অন্দরমহলের দায়িত্ব কে নেন? কে হেঁসেল সামলান? আর কে বাড়ি পরিষ্কার করেন?

Advertisement

পৃথা বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২১ ১৭:১৬
Share:

মৈনাক এবং নিরঞ্জন। ছবি: সোমনাথ রায়

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই কফি তৈরির তোড়জোড়। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজে খুলে দেখে নেওয়া, কী সব্জি রয়েছে। রান্নার দিদি এলে দরজা খুলে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া সারা দিনে কী রান্না হবে। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতা ওল্টানো। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চোখ কপালে, ‘এই রে! এত বেলা হয়ে গেল! এবার নিরঞ্জনকে ঘুম থেকে তোলার সময় হয়ে এল’।

Advertisement

ছবিটা আমাদের সকলের খুব চেনা। পার্থক্য একটাই। যিনি নিরঞ্জনকে ঘুম থেকে তুলে দিচ্ছেন, তিনি তাঁর প্রেমিকা নন। প্রেমিক মৈনাক। গত পাঁচ মাস ধরে চুটিয়ে সংসার করছেন দু’জনে।

‘‘সম্পর্কের আবার নারী-পুরুষ কী? সম্পর্ক তৈরি হয় দুই মানুষের মধ্যে,’’ মৈনাক কথা বলা শুরুই করলেন এই উক্তি দিয়ে।

Advertisement

সম্পর্ক না হয় মানা গেল। কিন্তু সংসার? বহু যুগ ধরে আমরা শুনে এসেছি, ‘সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে’। কিন্তু সংসারে যদি কোনও নারী না থাকেন, তবে কি তা অগোছাল হবে? বাড়ি-ঘর কে সামলে রাখবেন? কে হেঁসেল সামলাবেন আর কে-ই বা ঘরের কোণে ঝুল জমলে তা সযত্নে পরিষ্কার করার দায়িত্ব নেবেন? পুরুষেরা কি সংসারের দায়িত্ব নিতে আদৌ সক্ষম?

সংসারের যাবতীয় কাজ ভাগ করে নেন দু’জনে। ছবি: সোমনাথ রায়

নারী-পুরুষের সম্পর্কের সংজ্ঞা টপকে সমাজ এখন সমকামী সম্পর্কের বিষয়ে অবগত। সেই সম্পর্ক খোলা মনে মেনে নেওয়ার উদাহরণ সমাজে এখনও কম হলেও, এই ব্যতিক্রমী সম্পর্কগুলি এখন জ্বলজ্বলে বাস্তব। দুই পুরুষ বা দুই নারীকে এখন বহু ক্ষেত্রেই সংসার পাততে দেখা যাচ্ছে। বিদেশে তাঁরা বিয়েও করছেন, সন্তান বড় করছেন, সপরিবার রীতিমতো জীবন উদ্‌যাপন করছেন। শুধু বিদেশে কেন, আমাদের চারপাশেও এমন সংসারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তেমনই একটি সংসার টলিগঞ্জের মৈনাক দাস এবং নিরঞ্জন মণ্ডলের।

মৈনাক-নিরঞ্জনের সংসার কিন্তু মোটেই অগোছাল নয়। মন দিয়ে দু’কামরার ফ্ল্যাট সাজিয়েছেন তাঁরা। মৈনাক পেশায় রূপটান শিল্পী। মৈনাক-নিরঞ্জনের ফ্ল্যাটের অন্দরসজ্জা এতটাই সুন্দর যে, সাজ সেরে অনেক সময়ে ফোটোশ্যুটও এ বাড়িতেই সেরে ফেলেন বেশির ভাগ মডেল এবং নায়িকা। বাড়ি সুন্দর রাখার দায়িত্ব কার? মৈনাক না নিরঞ্জনের?

মৈনাক-নিরঞ্জনের সম্পর্ক শুরু হয় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। শুরু থেকেই একসঙ্গে থাকার কথা নিরঞ্জনকে জানিয়েছিলেন মৈনাক। নিরঞ্জন নিজের বাড়ি-পরিবার ছেড়ে আসেন। নতুন জায়গায় তাঁকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেন মৈনাক। দু’জনের অভ্যাস বেশ কিছু ক্ষেত্রে আলাদা। ‘‘নিরঞ্জনের একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোনোর অভ্যাস। আমি আবার খুব সকালে উঠে পড়ি। উঠে সকালের কাজগুলি সেরে ফেলি। কখনও ওকে বিরক্ত করি না। আবার এমন অনেক কাজ আছে যেগুলি ও-ই করে। আমাদের পোষ্য কুকুরছানা জারার দেখভাল বা গাছের পরিচর্যা আমি একদম পারি না। এই কাজগুলির দায়িত্ব সব ওরই,’’ বললেন মৈনাক।

গাছের যত্ন নেন নিরঞ্জন, হেঁসেল সামলান মৈনাক। ছবি: সোমনাথ রায়

দুই পুরুষের সংসার একদম মধ্যবিত্ত একটি পাড়ায়। দু’জনে বাজারে গেলে কিংবা রেস্তরাঁয় খেতে গেলে কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করাই স্বাভাবিক। কিন্তু মৈনাক জানালেন, টলিগঞ্জে তাঁর এই ধরনের অভিজ্ঞতা খুব একটা হয়নি। আবাসনের মানুষও তাঁদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। তবে অসুবিধা হয়েছিল অন্য জায়গায়। নিরঞ্জনের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। আত্মীয়েরা সব বাড়ির কাছে থাকেন। একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ-ই তাঁর জীবনযাপন মেনে নিতে পারেননি। আর একজন পুরুষের সঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্তও সহজে গ্রহণ করেননি। তাই মাঝেমাঝেই নিজের বাড়ি গিয়ে ২-৩ দিন থেকে আসেন নিরঞ্জন। মৈনাকও সে সময়ে নিরঞ্জনকে খুব একটা যোগাযোগ করেন না। ‘‘সারা জীবনই তো আমার সঙ্গে থাকবে। ওইটুকু সময়ে পরিবারের সঙ্গে কাটাচ্ছে। আমি তার মাঝে আর ঘন ঘন হোয়্যাটস্‌অ্যাপ করব কেন,’’ বললেন মৈনাক।

মৈনাক-নিরঞ্জনের আলাপ নেটমাধ্যমে। ১০ বছরেরও বেশি সময়ে ধরে মৈনাক একাই থাকতেন কলকাতা শহরে। কখনও কোনও সঙ্গীর প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। কিন্তু অতিমারি সব বদলে দিল। মনে হল, একজন সঙ্গী থাকলে জীবনটা মন্দ হয় না। সেই ভাবনা থেকেই সম্পর্ক। ভবিষ্যতে দু’জনের বিয়ের পরিকল্পনাও রয়েছে। এত দিনের একা থাকার অভ্যাস এখন পাল্টাতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর ব্যক্তিগত ‘স্পেস’-এ এখন আর একজনের নিত্য উপস্থিতি। ঝগ়ড়াঝাঁটি হয়? ‘‘এখনও পর্যন্ত খুব একটা নয়। আমি সম্পর্কে মানিয়ে নিতে জানি। অনেকে মনে করেন সমকামী সম্পর্ক মানেই একজনের হুকুম চলবে বেশি। অন্য জন হবে ‘মেয়েলি’। এটা একদমই উদ্ভট ধারণা। কোনও সম্পর্কেই এমন হওয়া কাম্য নয়। দু’জনে মিলেমিশে থাকবে, তবেই তো সংসার চলবে,’’ বললেন মৈনাক।

বাড়িতেই দু’জনের ‘ডিনার ডেট’। ছবি: সোমনাথ রায়

নিরঞ্জনও এই বিষয়ে একমত। তাঁদের বাড়িতে নিত্য অতিথিদের আনাগোনা। অতিথি আপ্যায়নের ভারও দু’জনে ভাগ করে নেন। মৈনাক খাওয়াতে ভালবাসেন। তাই সেই দায়িত্বে তাঁরই। নিরঞ্জন আবার খুব সহজে মিশে যেতে পারেন। তাই আড্ডা জমিয়ে রাখেন তিনিই। তবে নিরঞ্জনের মতে, মৈনাক মুখচোরা হলেও দারুণ রোম্যান্টিক! তাই মাঝেমাঝেই তাঁকে নানা রকম সারপ্রাইজ দেন। কখনও বাড়িতেই সপ্তাহান্তে ‘ডিনার ডেট’ তো কখনও সকালবেলা বিছানাতেই লোভনীয় জলখাবারের টেবিল সাজিয়ে দেন মৈনাক। আর পাঁচজনের কাছে যা ব্যতিক্রমী সম্পর্ক, তা মৈনাক-নিরঞ্জনের কাছে খুবই স্বাভাবিক। ‘‘সচেতন ভাবে কোনও জেন্ডার ভূমিকা ভাঙার জন্য আমরা কিছু করি না। যেটা সহজ-স্বাভাবিক মনে হয়, সে ভাবেই চলে আমাদের সংসার চলে,’’ বললেন নিরঞ্জন।

মেকআপ: সৌরভ নস্কর

স্টাইলিং: সূর্য শেখর বিশ্বাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement