দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে এমন ছবি। — নিজস্ব চিত্র।
পুজোয় তো আর মালিক বোনাস দেন না। তাই সারা বছর পরিষেবা নেন, এমন ক্রেতাদের কাছ থেকে ওঁরা পুজোর সময় ‘বকশিশ’ আশা করে থাকেন। কেউ দেন। কেউ দেন না। সেই হিসাবও মনে মনে কষা থাকে পাড়ার চায়ের দোকানের পল্টু কিংবা সেলুনকর্মী গোপালদের। এই বাড়তি উপার্জনটাই ওঁদের অনেকের কাছে পুজো। কিন্তু বাঙালি তিনটি ইংরেজি শব্দ বলা দিন দিন ভুলে যাচ্ছে। আর তাতেই ‘বকশিশ’ নামক উৎসবটাই হারিয়ে যাচ্ছে ওদের পুজো থেকে।
‘কিপ দ্য চেঞ্জ’। এমনিতে সব কথা বাংলাতে বলা ক্রেতারাও বিশেষ করে পুজোর সময়ে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে সেলুনে বলতেন। ধরা যাক, চুল কাটানোর বিল হল ৭০ টাকা। ১০০ টাকার নোট দিয়ে বলতেন, খুচরোটা আর ফেরত দিতে হবে না। আবার চায়ের দোকানে সবাই মিলে ৪২ টাকার খেয়েদেয়ে ৫০ টাকার নোট দিয়ে খুচরোটুকু নিতে চান না। ভাবছেন, মাত্র তো ৮টা টাকা! কিন্তু এই আট, আট করেই ৮০ হয়। ৮০-৮০ করে ৮০০ হয়। না, ‘হয়’ আর বলা যাবে না, ‘হত’ বলতে হবে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মোবাইলের মাধ্যমে ‘ইউপিআই’ পদ্ধতি চালু হওয়ায় খুচরো ফেরতের বালাই উঠে গিয়েছে। ভারী গলায় ‘কিপ দ্য চেঞ্জ’ বলার দিনও শেষ। আর তাতেই পল্টু বা গোপালদের মন ভাল নেই নতুন দিনের পুজোয়।
কথা হল, চন্দননগরের পালপাড়া এলাকার সেলুনকর্মী গোপাল প্রামাণিকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘‘যাঁরা বাঁধা খদ্দের, তাঁরা প্রতি বার আলাদা করে দিয়ে দেন। সবার বোনাস হলেও আমাদের তো হয় না। এই বকশিশের টাকাতেই পুজোর কেনাকাটা হয়। কিন্তু সেই টাকাটা কমে গিয়েছে মোবাইলের জন্য। নিয়মিত নন, এমন খদ্দেরদের থেকেও পুজোর সময় একটা ভাল টাকা আসত। পুজোর সময়ে তাঁরা ফেরতের খুচরো টাকাটা সাধারণত নেন না। কিন্তু এখন তো ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জনই মোবাইল দিয়ে টাকা মেটান। ফলে রোজগার অনেক কমে গিয়েছে।’’
দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইউপিআই। — ফাইল চিত্র।
একই অভিজ্ঞতা শ্যামল জানার। উত্তরপাড়ার একটি জনপ্রিয় চায়ের দোকানের কর্মী। ওঁরা মোট পাঁচ জন কাজ করেন চায়ের দোকানে। পুজোর অনেক আগে থেকেই ওঁদের ‘চাঁদা’ তোলা শুরু হয়ে যায়। নিয়মিত খদ্দেররা ৫০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত দেন। মোটা টাকার সবটা পাঁচ জনে ভাগ করে নেন। কিন্তু অন্য রোজগারটা একেবারেই কমে গিয়েছে। সারা বছরই খুচরো আয় ছিল। একটা সিগারেট কিনে ফেরতের ২-৩ টাকা অনেকেই ওঁদের হাতে দিয়ে দিতেন পার্স বা পকেট ভারী করবেন না বলে। শ্যামলের বক্তব্য, ‘‘এই গুগ্ল পে এসে গিয়ে আমাদের রোজগার কমিয়ে দিয়েছে। সারা দিনে খুচরো আয় যেটা হয় সেটা দিনের শেষে কোনও কোনও দিন ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত হয়। পুজোর সময় আরও একটু বেশি। কারণ, এই সময়ে সবাই একটু দেওয়া-থোয়ার মুডে থাকে।’’ শ্যামলের সঙ্গী পঞ্চাও বলছেন, ‘‘দেওয়া-থোয়ার মুডটা থাকলেও পাওনাগণ্ডা কমছে। বেশির ভাগ খদ্দেরই তো স্ক্যান করে পয়সা মিটিয়ে দিচ্ছেন।’’ সামনে না বললেও ওঁদের রাগ মালিকের উপরে। পুজোর আগে আগেই তিনি দোকানের কাউন্টারে ‘কিউআর কোড’ লাগিয়ে দিয়েছেন। ওঁদের কাছেও যে মোবাইল ফোন নেই তা নয়। তবে ‘দয়ার দান’ কি ওই ভাবে চাওয়া যায়?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রুবি সাঁই অবশ্য মনে করছেন, ওই ভাবেই চাইতে হবে। তিনি বলেন, ‘‘সময়ের বদলকে তো মেনে নিতেই হবে। এখন নগদ টাকা সঙ্গে রাখার রেওয়াজ কমছে। সেটা নিরাপদও। দিন দিন এটা বাড়বে। তাই বকশিশ নেওয়ার জন্যও ইউপিআই মাধ্যম চাই। সময়কে তো অস্বীকার করা যায় না।’’ রুবি মনে করেন, খুব তাড়াতাড়ি এমন একটা দিন আসবে যখন ভিক্ষার ক্ষেত্রেও ইউপিআই নির্ভর হতে হবে। প্রথম প্রথম মানুষ বাঁকা চোখে দেখলেও মেনে নেবে। তিনি বলেন, ‘‘এখন প্রবীণেরা তবু টাকাপয়সা সঙ্গে রাখেন, কিন্তু যুবকেরা একেবারেই নয়। কিন্তু তাঁরা ইউপিআই মাধ্যমে ১০ টাকা ভিক্ষা দিতেই পারেন।’’
এই সমস্যা যে শুধু এ দেশের নয়, তা-ও জানালেন রুবি। বললেন, ‘‘অনেক দেশে তো দেখছি হোটেল, রেস্তরাঁয় আলাদা করে টিপস দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা বিলের সঙ্গেই ইউপিআই করে দেওয়া যায়। কার্ডেও মেটানো যায়।’’ ইদানীং, কলকাতা শহরের কিছু রেস্তরাঁতেও এমন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে চায়ের দোকানের পঞ্চু কিংবা সেলুনের গোপালদের মতো বকশিশকে ‘দয়ার দান’ না ভেবে ‘প্রাপ্য’ মনে করেন রেস্তরাঁর খাদ্য পরিবেশকেরা (ওয়েটার)। যেমন করে নিচু স্তরের সরকারি কর্মী থেকে রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের ডেলিভারি বয় ‘চা খাওয়ার পয়সা’ চান তেমন করেও নয়, ওয়েটাররা সরাসরি বকশিশ চেয়ে নেন। কিন্তু তাঁদেরও সেই দিন নেই। মৌরি আর টুথপিকের সঙ্গে প্লেটে বিল রেখে দেওয়ার সেই চল আজও রয়েছে। কিন্তু সেখানে ক্রেতা নগদ টাকার বদলে রাখেন কার্ড কিংবা চেয়ে নেন ইউপিআই কোড।
আগে ক্যাশিয়ারের কাছে বিলের টাকা জমা করে এসে ফেরতের টাকা পয়সা মৌরির প্লেটেই রাখতেন ওয়েটাররা। এক শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বড় নোটটা তুলে নিয়ে বাকিটা রেখে যেতেন। কেউ কেউ পুরোটাই রেখে দিতেন, আবার অনেকে শুধু খুচরোটা তুলে বড় নোট রাখতেন। এখন সে সব প্রায় নেইই। আলাদা করে কেউ ৫০, কেউ ১০০ টাকা দেন। কিন্তু সব মিলিয়ে বকশিশ বাবদ রোজগার কমে গিয়েছে বলে জানালেন মধ্য কলকাতার একটি পানশালার কর্মী মহম্মদ সাবির। তিনি জানালেন, ছোট থেকে মাঝারি মাপের পানশালা বা রেস্তরাঁয় ওয়েটারদের বেতন খুবই কম হয়। দিনের শেষে বকশিশের ভাগটাই মূল আয়। ফলে খুবই অসুবিধা। সাবির বললেন, ‘‘সপ্তমীর দিনই একটি পরিবার খেয়ে গেল। বিল হয়েছিল ৩,৭০০ টাকার মতো। পুরোটা কার্ডে মিটিয়ে হাতে দিল ৫০ টাকা। আগের দিন হলে এটা ২০০ টাকা তো হতই।’’ সাবির যেখানে কাজ করেন, সেখানে নিয়ম না-থাকলেও অনেক রেস্তরাঁতেই ‘টিপ্স দেবেন না’ বলে নোটিসও থাকে। সাবিরের বক্তব্য, ওই সব রেস্তরাঁয় বেতন বেশি। সেই সঙ্গে পরিষেবা করের (সার্ভিস চার্জ) একটা অংশ কর্মীরা পান।
যাঁরা কেতাদুরস্ত তাঁরা অবশ্য রীতি মেনেই ‘টিপ্স’ দেন। সাধারণ ভাবে কলকাতায় মোট বিলের ১০ শতাংশই বড় রেস্তরাঁয় বকশিশ দেওয়ার রীতি। সেটা ১৫ শতাংশ পর্যন্তও হয়। গোটা বিশ্বেই এমন রীতি চালু রয়েছে। কোনও কোনও দেশে বকশিশ নিষিদ্ধ হলেও বাকি জায়গায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দেওয়াই রীতি। এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের বক্তব্য, ‘‘কিছু দিন আগে কালিফোর্নিয়ায় গিয়েছিলাম। একটি রেস্তরাঁয় ১০ শতাংশ বকশিশ দেওয়ায় ওয়েটার বললেন ওটা ১৫ শতাংশ করতে হবে। কারণ, তাঁকে আয়কর মেটানোর সময়ে ১৫ শতাংশ আয় দেখাতে হবে।’’ দেশে দেশে নিয়ম, রীতি আলাদা হয় জানিয়ে অভিরূপ বলেন, ‘‘আসলে আমরা এখানে চায়ের দোকানে, সেলুনে যেটা দিয়ে থাকি সেটা ভালবেসে। পুজোর দিনগুলো ওঁদেরও ভাল যাক ভেবে। তাই সকলে যদি ইউপিআইতে টাকা দিলেও ইচ্ছা মতো বকশিশ নগদে দিয়ে দেন তা হলেই মিটে যায়।’’ বাড়িতে যাঁরা খাবার বা অন্য কিছু ডেলিভারি করেন তাঁদের বকশিশ দেওয়ার বিষয়ে অভিরূপের বক্তব্য, ‘‘বাড়িতে পাঠানোর জন্য ‘ডেলিভারি চার্জ’ ধরে দামটা এতটাই বাড়ানো থাকে যে এর উপরে আলাদা করে বকশিশ দেওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না অনেকেরই।’’ খাবার পরিবেশনকারী অ্যাপগুলিতে অবশ্য ‘টিপ’ দেওয়ার জন্য অপশনও থাকে। তবে সেই ‘টিপ’ কে পান তা স্পষ্ট নয়। অনেকেই তাই নিজের হাতে নগদে ‘খুশি’ করে দেন।
এ সবের ধার ধারছেন না টোটোচালকেরা। ‘দাদা’ অটোচালকেরা অতীতে যা শিখিয়েছেন, সেই পথেই পুজোর সময় সব ভাড়ার সঙ্গে পাঁচ টাকা বেশি। কেউ কেউ এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করলেও সংখ্যাটা খুব বেশি নয় বলে জানালেন দক্ষিণেশ্বরের টোটোচালক রঞ্জন পাল। তিনি বলেন, ‘‘এটুকু বেশি তো নিতেই হবে দাদা। পুজোর সময় সবাইকেই রোজগার বাড়িয়ে নিতে হয়। আর আমাদের উল্টে কমে। কারণ, বিকেল ৪টের পরে তো রাস্তায় গাড়ি নামাতেই দেয় না পুলিশ।’’