মুক্তাক্ষরে বাঁধা থাক মনের তল

গোটা গোটা অক্ষর হোক বা টানা, সন্তানের হাতের লেখা সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন হবে কী ভাবে?আয়নার সামনে দাঁড়ালে কারও বহিরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। মনের কথা জানতে গেলে চোখ রাখতে হয় চোখে। তবেই না খানিক আঁচ করা যায় মনের তল! হাতের লেখাও তেমনই কথা বলে নিজের মনের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

সে এক সময়ের কথা। চিঠি লেখার অভ্যেস তখনও হারিয়ে যায়নি। তাই বছর ঘুরে গেলেও হলদে পাতার ভাঁজে ফুটে থাকা মুক্তোর মতো হাতের লেখার চিঠি পড়তে দারুণ রোমাঞ্চ জাগত। এমনকি বেশ কিছু লেখকের পাণ্ডুলিপিও অনেকে বাড়িতে ফ্রেমবন্দি করে সাজিয়ে রাখেন। কারণ কী? একটাই। সুন্দর হাতের লেখা। এমন হাতের লেখা যা মুক্তোর সৌন্দর্যকেও হার মানায়। কারও লেখা ঝরঝরে, কারও ঈষৎ বাঁকা, কারও বা গোটা গোটা, স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন। ঠিক যে ভাবে কারও চেহারা একান্তই নিজের, হাতের লেখাটাও তেমনই তাঁর একেবারে নিজস্ব। কিন্তু কী ভাবে হাতের লেখা হবে মুক্তোর সমান? কেমন ভাবেই বা রপ্ত করবেন সেই মুনশিয়ানা?

Advertisement

লেখায় রহস্য

Advertisement

আয়নার সামনে দাঁড়ালে কারও বহিরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। মনের কথা জানতে গেলে চোখ রাখতে হয় চোখে। তবেই না খানিক আঁচ করা যায় মনের তল! হাতের লেখাও তেমনই কথা বলে নিজের মনের। গ্রাফোলজিস্টদের মতে, হাতের লেখা থেকে যেমন ব্যক্তিত্ব যাচাই করা যায়, তেমনই আবার বোঝা যায় তাঁর মনে লেখার মুহূর্তে কী চলছে। তাই কখনও কখনও আপনার বাড়ির সংবেদনশীল খুদেটির খাতায় একটি পাতাতেই হরেক ধরনের হাতের লেখা দেখলে অবাক হবেন না। বরং তা থেকে তার মনের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।

ভাল লেখা, ছন্দে লেখা

ভাষার মতোই লেখারও ছন্দ আছে। অক্ষরছন্দ। সেই ছন্দে হাতের লেখাকে বাঁধতে গেলে শুরু করতে হবে প্রথম থেকেই। যে শিশুটি হাতেখড়ির পরে প্রথম অক্ষর লিখতে শুরু করে, তাকে ঠিক ভাবে অক্ষর লেখা শেখানো জরুরি। অনেকে নিজেই হয়তো ‘খ’, ‘ঘ’, ‘ঙ’, ‘ভ’, ‘শ’ জাতীয় অক্ষরগুলি পেঁচিয়ে, বিকৃত করে লেখেন। স্বাভাবিক ভাবে বাড়ির ছোট্টটিকেও শেখান সে ভাবেই। তাই ভুলভ্রান্তি এড়াতে নিজে আগে অক্ষর ভাল করে দেখে, জেনে তার পরে শেখান। প্রাথমিক ভাবে দাঁড়ি, গোল, অর্ধগোলাকার... ইত্যাদি নানা আকার বাচ্চাকে রপ্ত করাতে পারেন। ধীরে ধীরে এগোতে পারেন অক্ষরের দিকে। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি... যে অক্ষরই শেখান, তা গোটা গোটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দির ক্ষেত্রে ডাবল লাইনড খাতার পাতায় লাইন ভর্তি করে লেখাতে পারেন। ইংরেজির জন্য শুরুর দিকে ফোর লাইনার পাতাই যথেষ্ট। হাতের লেখা ভাল হতে শুরু করলে তার পরে সিঙ্গল রুলড পেপার এবং পরে একেবারে সাদা পাতায় লেখার অভ্যেস করতে হবে। হাতের লেখা ভাল, তবে তার লাইনমাত্রা নেই। লেখার সময়ে লাইন এঁকেবেঁকে চলে নিজের মতো— এটা মোটেও কাজের কথা নয়। দরকারে মার্জিন ধরে লেখার অভ্যেস করাতে হবে।

অভ্যেস থাকুক জারি

হাতের লেখা ভাল করার জন্য বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে পারেন...

• প্রথমে স্লেট, পরে হাতের লেখা শেখার বইয়ে শিশুকে অভ্যেস করাতে পারেন। তার পরে খাতার পাতায় অভ্যেস করানো যায়।

• সাদা পাতায় দু’টি শব্দের মাঝে এবং দু’টি লাইনের মাঝে পর্যাপ্ত ফাঁক রেখে লিখলে অপটু হাতের লেখাও পড়তে বোধগম্য হয়। তাই গ্যাপ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

• পেনসিল, পেন ধরতে হবে শিসের ডগা থেকে অন্তত দেড়-দু’ইঞ্চি দূরে। এতে আঙুল ঘোরানোর মতো যথেষ্ট স্পেস পাওয়া যাবে। হাতের লেখাও হবে ভাল।

• হাতের লেখার অভ্যেস রাখা জরুরি। প্রত্যেক সপ্তাহে বাংলা, ইংরেজি অন্তত দু’পাতা এবং ছুটি থাকলে আরও বেশি করে হাতের লেখা অভ্যেস করা জরুরি। অনেকেই দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলে শিশুর হাতের লেখায় তেমন মন দেন না। কিন্তু অন্তত ১২-১৩ বছর পর্যন্ত হাতের লেখার অভ্যেস করার নিয়ম থাকলে তা ভালই।

• হাতের লেখা বদলানো স্বাভাবিক। তৃতীয় শ্রেণিতে এক রকম আর চতুর্থ শ্রেণিতে উঠে তা বদলে গেলে অবাক হবেন না। খেয়াল রাখুন, বদল যেন এগোয় ভালর দিকেই।

• প্রাথমিক ভাবে হাতের লেখা অভ্যেস করতে গেলে একটি লাইনই বারবার লিখতে হয়। সন্তান বড় হলে ওকে গল্পের বই ধরিয়ে দিয়ে, তা থেকে টানা লিখতে দিতে পারেন। এতে হাতের লেখার অভ্যেস হবে, নতুন গল্প, বই পড়ার চর্চাও থাকবে। বাড়বে পড়ার অভ্যেসও।

• গোটা গোটা অক্ষরে লেখার অভ্যেস জরুরি। অনেক অভিভাবকেরই ইচ্ছে থাকে, তাঁর সন্তান যেন কার্সিভ বা টানা হাতের লেখায় লেখে। কিন্তু কার্সিভ অভ্যেস করাতে গিয়ে যেন অক্ষরের রেখা, আকার বদলে ও পেঁচিয়ে না যায়। তার চেয়ে আগে অক্ষরটি ভাল ভাবে গোটা গোটা লেখার অভ্যেস করে নিয়ে এগোনো যেতে পারে কার্সিভে।

• অন্তত আট-ন’বছর বয়স পর্যন্ত পেনসিলে লেখা দরকার। এর পরে এগোনো যেতে পারে পেনের দিকে। তবে অনেক স্কুলে পেনের অভ্যেস চালু হয় আরও আগে। তাই পেনসিল থেকে পেন ব্যবহার করার সময়ে ঝর্না কলম বা ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখাই বাঞ্ছনীয়। তার পরে জেল পেন। সবশেষে ব্যবহার করা যেতে পারে বলপয়েন্ট পেন।

• পেনের গ্রিপ ভাল হওয়া জরুরি। অনেক সময়েই সস্তার পেনে শক্ত গ্রিপে আঙুলে ব্যথা হয়, কড়া পড়ে। নরম গ্রিপের পেনে লেখাই বাঞ্ছনীয়।

• ঝর্না কলমে তাড়াতাড়ি লেখা যায় না— এ ধারণা ভুল। চাইলে এবং অভ্যেস করলে ঝর্না কলম থেকেই বেরোতে পারে অনর্গল শব্দরাশি।

হাতের লেখা ভাল করার অভ্যেস শুরু হোক সন্তানের জীবনের একদম প্রথম ভিত থেকেই। তবে প্রাপ্তবয়স্করাও চাইলে অভ্যেস করতে পারেন হাতের লেখা। তা হতাশা-অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে। কিপ্যাড, কিবোর্ডের যুগে হাতের লেখার নিজস্বতাকে আঁকড়ে ধরতে পারেন আরও বেশি করে। দিনের শেষে ডায়রির একটি খালি পাতা না হয় হাতে লিখেই ভরালেন। দিনলিপি কিংবা কল্পনার আখর... ডানা মেলুক আপনারই হাতের লেখায়।

মডেল: স্বর্ণাভ ঘোষ

ছবি: জয়দীপ মণ্ডল

মেকআপ: সৌমেন সেনগুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement