সুস্থ থাকতে রান্না করার পদ্ধতিতেও আনতে হবে কিছু বদল। ছবি: আইস্টক।
রান্নার পদ্ধতিগত কিছু ভুলের জন্যই অনেক অসুখ ডেকে আনি আমরা। শুধু ডায়েট মেনে চলাই নয়, অসুখ এড়াতে বাদ দিতে হয় সে সব ভুলও। এক বার রান্নার পর সেই পোড়া তেল আর ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়েও নানা নিয়মকানুন আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে— তেলের ধরন, কত তাপমাত্রায় ভাজাভুজি হয়েছে, কত ক্ষণ ধরে গরম হয়েছে, আদৌ ডিপ ফ্রাই হয়েছে নাকি উপর উপর হালকা ফ্রাই এই সব কিছুর উপরেও নির্ভর করে পোড়া তেলের পুনর্ব্যবহারের বিষয়টি। তবে তেল ঘোলা হলে জৈব উপাদানগুলি নষ্ট হয়েছে বুঝতে হবে। সেই তেল আর ব্যবহার করা উচিত নয়।
শুধু তেলের বিষয়টিই নয়, রান্নার কিছু ভুলভ্রান্তি নিয়েও সাবধান হতে হবে। সুস্থ থাকতে তাই রান্না করার পদ্ধতিতেও তাই আনতে হবে কিছু বদল। কোন কোন নিয়ম মানতে হবে রান্নার ক্ষেত্রে?
আরও পড়ুন: রান্নার নানা পর্বের নানা ভুল শোধরাবেন কী করে?
আঁচ ও তেল দুইয়ের দিকেই খেয়াল রাখতে হবে রান্নার সময়। ছবি: আইস্টক।
রান্নার নিয়ম
সেদ্ধ, স্বাস্থ্যকর হলেও স্রেফ সেদ্ধ খাবার দিনের পর দিন মুখে রুচবে না, সেটা যেমন সত্যি, আবার ভুল পদ্ধতিতে সেদ্ধ করলে পুষ্টি মাঠে মারা যাবে, সেটাও সত্যি৷ ধরুন, খরচ ও সময় বাঁচানোর জন্য শাক–সব্জি–মাংস কুকারে সেদ্ধ করে তার পর কষানোর প্ল্যান করেছেন, ভাল কথা৷ কম সময় নিয়ে ঢেকে রান্না করলে খাবারের পুষ্টি বজায় থাকে৷ কিন্তু সমস্যা হল, কষানোর সময় যদি সেই জল ফেলে দেন, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ও উপকারি খনিজ পদার্থের প্রায় ৬০–৭০ শতাংশ জলের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে৷ ভাতের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি৷ ফ্যান ফেলে দিলে অনেক পুষ্টিও তার সঙ্গে জলে যায়৷ অতএব, সেদ্ধ করার সময় এমন জল দিন যা শোষিত হয়ে যায়৷ সব্জি বা মাংসের বেলায় ওই জল গ্রেভিতে ব্যবহার করুন৷ কত ক্ষণ রান্না করছেন তার উপরও পুষ্টির হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে৷ কাজেই জল ফুটতে শুরু করার পর তাতে চাল, ডাল, সব্জি দিন৷ রান্না করুন কম আঁচে, ঢেকে বা কুকারে৷ ভাপে রান্না, ভাপে রান্না করলে পুষ্টির প্রায় সবটুকু বজায় থাকে৷ স্বাদও ভাল হয়৷ কখনও আবার ভাপানোর পর স্বাদ বাড়াতে ঢাকা দিয়ে হালকা করে কষিয়ে নেওয়া যেতে পারে৷ ভাপানো টম্যাটো, গাজরের পুষ্টিগুণ বেশি৷ ভাপানো ব্রকোলিতে থাকে গ্লুকোসিনোলেটস যা শরীরে গিয়ে আইসোথায়োসেনটে পরিণত হয়, যা ক্যানসার কোষের গতি মন্থর করতে পারে৷ পোচ, ডিমের মতো মাছও পোচ করা যায়৷ গরম কড়াইতে অল্প জল দিয়ে ঢ়াকা দিয়ে রান্না করলে ও পরে অল্প নুন, মরিচ, লেবু দিলে স্বাদ ও পুষ্টি থাকে অঢেল৷ ফল ও নরম শাকসব্জিও এ ভাবে খাওয়া যেতে পারে৷
গ্রিলের নিয়ম
গ্রিল করা খাবার খেতে ভাল, পুষ্টিকর, ক্যালোরিও কম৷ তবে গ্রিলের পোড়া অংশগুলি নিয়মিত খেলে প্যানক্রিয়াস ও ব্রেস্ট ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ে৷ এ ছাড়া উচ্চ তাপে মাংসের ফ্যাট ও প্রোটিনের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়, যাদের প্রভাবে হৃদরোগ ও ডায়াবিটিসের আশঙ্কা বাড়ে৷ চারকোলে গ্রিল করলে চর্বি ও মশলা গরম কয়লার উপর পড়ে যে ধোঁয়া হয়, তাতে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকে৷ শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে৷ শ্বাসকষ্টের ধাত থাকলেও সমস্যা হয়৷ কাজেই বিপদ এড়াতে মেনে চলুন কিছু বিষয়।
মাংসের যে অংশে কম চর্বি আছে (লিন কাট) সেই অংশ গ্রিল করুন৷ সম্ভব হলে মাটন, বিফ বা পর্ক খাওয়া একটু কমিয়ে খান দেশি চিকেন৷ গ্রিল করার পর যে অংশ একটু বেশি কালো হয়ে যাবে, তা খাবেন না৷ চারকোলে গ্রিল না করে ইলেকট্রিক বার বি কিউ মেশিনে গ্রিল করুন৷ ব্রয়েলিং, নরম মাংসের পাতলা টুকরোকে উচ্চ তাপে খুব কম সময়ে রান্না করা হয়৷ স্বাদ বদলাতে খেতে পারেন৷ তবে অত উচ্চ তাপে পুষ্টি কমে যায় বলে নিয়মিত না খাওয়াই ভাল৷ সতে, কড়াইয়ে সামান্য তেল দিয়ে কম আঁচে শাক–সব্জি–মাছ–মাংসের ছোট টুকরো হালকা মশলা দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে নিলেই খাবার তৈরি৷ এবার তাতে লেবুর রস, ধনে পাতা ইত্যাদি ছড়িয়ে খেয়ে নিন৷ অলিভ অয়েল ব্যবহার করলে খাবার আরও পুষ্টিকর হয়৷ কম আঁচে রান্না করলে খাবারের পুষ্টিগুণ এমনিই বেশি থাকে৷ তার উপর যদি অলিভ অয়েলে রান্না হয়, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমান বেড়ে যায়৷ টম্যাটো–গাজর মেশালে তা আরও বাড়ে৷
আরও পড়ুন: পুজোর আগে বা়ড়তি মেদ ঝরাতে চান? সুস্থ থেকে ওজন কমাতে ভরসা কিন্তু এই ডায়েট!
গ্রিলের পোড়া অংশগুলি নিয়মিত খেলে প্যানক্রিয়াস ও ব্রেস্ট ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ে৷
মাইক্রো আভেনে রান্না
মাইক্রো আভেনে রান্না করলে খাবারের সব পুষ্টিগুণ অটুট থাকে৷ কারণ এতে যে বেতার তরঙ্গ তৈরি হয় তা খাবারের অণুগুলিকে কেবল উত্তেজিত করে তোলে৷ ফলে তাদের মধ্যে যে প্রবল অস্থিরতা তৈরি হয়, তা থেকে তৈরি হয় তাপ৷ রান্না হয় সেই তাপে৷ তবে গরম করার সময় খাবার একটু শুকিয়ে যেতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে অল্প জলের ছিটে দিয়ে নিন৷ তবে খেয়াল রাখতে হবে খাবার যেন প্লাস্টিক পাত্রে গরম করা না হয়৷ সিরামিক বা কাচের পাত্রে করা উচিত৷ তাতেও যেন প্লাস্টিকের ঢাকা না থাকে৷
কাঁচা খেলে
খাবার রান্না করলে কিছুটা হলেও পুষ্টিগুণ কমে, সে আপনি যেভাবেই রান্না করুন না কেন৷ ব্যতিক্রম টম্যাটো, গাজর, মিষ্টি আলু, পালং, লঙ্কা৷ সে জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কাঁচা শাক–সব্জি–ডিম ইত্যাদি খাওয়ার চল আছে৷ আমরাও খাই বিভিন্ন সালাড হিসেবে৷ এমনিতে এতে ক্ষতি নেই৷ কিন্তু আমাদের দেশে যেখানে বিষাক্ত কীটনাশক ও সারের ব্যাপক প্রচলন, মাঠেঘাটে মল–মূত্র দূষণের রমরমা, সেখানে কাঁচা খাওয়ার নানা বিপদ আছে৷
ওজন বেড়ে যাওয়া, বন্ধ্যাত্ব, মস্তিষ্কের অসুখ, হার্টের রোগ, পেটের গোলমাল, ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদির আশঙ্কা থাকে৷ তার উপর শাক–সব্জি–মাছ প্রভৃতিকে তাজা দেখানোর জন্য যে ভাবে বিষাক্ত রং ব্যবহার করা হয়, সেখানে কোনও কিছু কাঁচা খাওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ এমনকি যে নানা রকম পুষ্টির খাতিরে রঙিন শাক–সব্জি খাওয়া এক সময় বাধ্যতামূলক ছিল, তাও আজকাল বুঝেশুনে খেতে বলছেন চিকিৎসকরা৷ অতএব নিতান্ত নিজের বাগানে, জৈব সারে পুষ্ট শাক–সব্জি হলে কাঁচা খেতে পারেন, নয়তো নয়৷ তাও কিছু ক্ষেত্রে জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকতে পারে৷