শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে ভেগান ডায়েটে সাপ্লিমেন্টস খেতেই হবে। ফাইল ছবি।
চিনের বাজারে বাদুড়ের মাংস থেকেই কি করোনা ছড়িয়েছে? এ নিয়ে ভাইরোলজিস্টদের মতবিরোধ রয়েছে। এই সূত্র ধরেই আবার জমে উঠেছে আমিষ-নিরামিষের তরজা। মহামারির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ এপিডেমিকের পিছনে আছে কোনও না কোনও প্রাণীর শরীর থেকে আসা জীবাণু। তাই দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীদের একাংশ জোর দিচ্ছেন প্রাণীজ প্রোটিন বর্জন করার উপর।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের অনেকের মত, দীর্ঘজীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে নিরামিষ খাবারের মধ্যে। আবার অনেকের মত প্রাণীজ প্রোটিন না খেলে শরীরের অনেক প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি হয়। নিরামিষ আমিষের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। শুধুমাত্র শাকসব্জি খেলে তাদের ভেজিটেরিয়ান বলে এ কথা সবারই জানা। কিন্তু ভেগান শব্দটির সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় নেই। ‘’নিরামিষাশীরা যখন প্রাণীজাত সমস্ত খাবারের সঙ্গে আড়ি করেন, তখন তাদের বলে ভেগান,’’ এমনই বললেন নিউট্রিশনিস্ট ইন্দ্রাণী ঘোষ। অর্থাৎ শুধু মাছ মাংস নয় ভেগানরা ডিম, দুধ আর দুধের যে কোনও খাবার যেমন ছানা,দই, পনীর, সন্দেশ, রসগোল্লাও খান না। এমনকি, উল, চামড়া বা সিল্কের পোশাকও পরেন না। প্রাণী-সহ পরিবেশ বাঁচাতেই তাদের এই উদ্যোগ। আমাদের খাবার জন্যই হাঁস, মুরগি, গরু, মোষ, শূকর ইত্যাদি পালন করা হয়। এই বিষয়ে ভেগানদের মত, কৃত্রিম ভাবে চাষ করায় পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
১৯৪৪ সালে ডোনাল্ড ওয়াটসনের উদ্যোগে ভেগান সোসাইটি গড়ে ওঠে। ২০১০ থেকে ভেগান ডায়েট নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা গেছে যে শাক সবজি, ফলে থাকা বিভিন্ন ফাইটোকেমিক্যালস (উদ্ভিদে থাকা বিশেষ প্রাকৃতিক রাসায়নিক যা বিভিন্ন রং ও গন্ধ সৃষ্টি করে, বিভিন্ন ফল ও সব্জিতে প্রায় ৪,০০০ ফাইটোকেমিক্যালস পাওয়া যায় যা শরীরের জন্যে অত্যন্ত উপকারী, যেমন টোম্যাটো, তরমুজ, গাজর, আম, জাম, পালং শাক ইত্যাদি) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এই কারণেই আমেরিকা, ইউরোপের মানুষদের মধ্যে ভেগান ডায়েট ক্রমশ অত্যন্ত জনপ্রিয় হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে পুষ্টিবিজ্ঞানের শিক্ষক সুস্মিতা ঠাকুর জানালেন, প্রচুর ভিটামিন মিনারেলস ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ ভেগান ডায়েট বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, টাইপ টু ডায়াবিটিস, হার্টের অসুখ, ওবেসিটি, হাই ব্লাড প্রেশারের মত অসুখ প্রতিরোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছে।
আরও পড়ুন: করোনা-আবহে দাঁতের চিকিৎসায় অবহেলা করছেন? কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
জাপান ও ইতালির বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জেনেছেন যে, ভেগান ডায়েট সবার জন্যে উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে প্রাণীজ প্রোটিনের অভাবে শরীরে ভিটামিন বি-১২ এর অভাবজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে বাচ্চাদের । তাই আমিষ-নিরামিষ মিলিয়ে খাওয়াই ভাল। নিরামিষ ও ভেগান ডায়েট প্রসঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেন পুষ্টিবিদ ইন্দ্রাণী ঘোষ। তাঁর কথায়, ভেগান ডায়েট করলে সয়াবিন খেতেই হবে। কেননা শরীরের প্রয়োজনীয় প্রায় সব কটি অ্যামাইনো অ্যাসিড (প্রোটিনের মূল উপাদান উপাদান) থাকে সয়াবিনে। কিন্তু ভিটামিন বি-১২ থাকে না।
আরও পড়ুন: করোনাকালে সংক্রমণের ভয় পা থেকেও? মেনে চলতেই হবে এ সব নিয়ম
ভেগান ডায়েটে যাঁরা মানিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের ৮৩% ভিটামিন বি-১২ এর অভাব জনিত সমস্যায় ভোগেন। তাই যাঁরা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খান না, তাঁরা অবশ্যই বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন বি-১২ সাপ্লিমেন্ট খাবেন। ভিটামিন বি-১২ রক্ত তৈরি ও মস্তিষ্কের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। তাই ভেগান ডায়েট করলে অ্যানিমিয়ার পাশাপাশি স্মৃতি শক্তির ঘাটতি হতে পারে। তাই ভেগান ডায়েট করতে গেলে অবশ্যই পুষ্টি বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে হবে, জানান সুস্মিতা দেবী।
মাছ-মাংস থেকে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ডোকোসাহেক্সায়োনিক অ্যাসিড (ডিএইচএ) পাওয়া যায়, যা আমাদের মস্তিষ্ক, রেটিনা ও স্নায়ুতন্ত্রের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ভেগান ডায়েটে ডিএইচএ অত্যন্ত অল্প থাকায় সাপ্লিমেন্টস নিতেই হবে। প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করতে ভেগান ডায়েট অত্যন্ত কার্যকর। যাঁদের বংশে প্রস্টেট ক্যনাসারের ইতিহাস আছে তাঁদের এই অসুখের একটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
পঞ্চান্ন পেরনোর পর ভেগান ডায়েট অভ্যাস করে দেখতে পারেন। যাঁদের ইতিমধ্যে এই ক্যানসার হয়েছে ও চিকিৎসা চলছে তাঁরাও পরীক্ষামূলক ভাবে কিছুদিন ভেগান ডায়েট করলে নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন শারীরিক ভাবে কতটা ভাল বোধ করছেন। তবে একথাও ভুললে চলবে না ভেগান ডায়েটে ভিটামিন ডি,ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক ও আয়রন তুলনামূলক ভাবে কম থাকে, তাই সাপ্লিমেন্টস নিতে হয়। একই সঙ্গে “আপ রুচি খানা” ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। সুষম খাবার খেয়ে ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।