কথাতেই আছে চোখে হারানো... সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে চক্ষুরত্ন সবচেয়ে দামি। ঘটনাচক্রে আমরা হয়তো বেশি অবহেলা এই অঙ্গেরই করে থাকি। বড় বয়সে চোখের সমস্যা যত দ্রুত ধরা পড়ে, ছোটবেলায় সময় লাগে। অনেক সময়েই বাচ্চা দুষ্টুমি করছে ভেবে অভিভাবকেরা গুরুত্ব দেন না। চিকিৎসকেরা কিন্তু জোর দিচ্ছেন নিয়মিত চোখ পরীক্ষার উপরে। আর তা করা উচিত ছোট বয়স থেকেই।
কোন বয়স থেকে পরীক্ষা জরুরি?
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘শিশুর জন্মের পরেই একটা প্রাথমিক পরীক্ষা করে নেন চিকিৎসকেরা। তার পর ছ’মাস বয়সে একটা চেকআপ জরুরি। শিশুর কর্নিয়া, ভিস্যুয়াল অ্যাক্সিস ঠিক আছে কি না, গ্লকোমা আছে কি না অথবা আলোর রিফ্লেকশনে তার প্রতিক্রিয়া— ছ’মাসের মধ্যেই দেখে নিতে হবে।’’ এগুলো সন্তানের রুটিন চেকআপেরই অংশ। শিশু একটু বড় হওয়ার সময়ে তার চোখের মুভমেন্ট ঠিক মতো হচ্ছে কি না দেখে নিতে হবে। আলো দেওয়া খেলনা বা টর্চ নিয়ে ডান-বাঁ দিকে ঘোরানো, কোনও উজ্জ্বল রঙের খেলনা তার সামনে ধরলে সে কী করছে, কোনও আওয়াজ শুনে সেই দিকে তাকাচ্ছে কি না আর তাকালেও চোখের মণি কত ডিগ্রি সরছে, মণির রঙ স্বাভাবিক কি না— বাড়িতে বাবা-মাকে এগুলো খেয়াল করতে হবে। চোখের দৃষ্টিতে কোনও অস্বাভাবিকতার আভাস পেলে অবশ্যই চিকিৎসককে জানাতে হবে। শিশুর তিন-চার বছর বয়স থেকে বছরে একবার আই টেস্ট করাতে পারলে ভাল।
কী ভাবে সমস্যা বুঝবেন
খুব ছোট শিশুরও চোখে পাওয়ার থাকতে পারে। দু’-তিন বছরের বাচ্চার চোখে চশমা এখন হামেশাই দেখা যায়। তবে অধিকাংশ সময়েই সমস্যা ধরা পড়তে সময় নেয়। অর্থোঅপটিস্ট গার্গী চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘শিশুটি হয়তো স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড দেখে লেখার সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল করছে। বা বই দেখে ভুল পড়ছে... বাবা-মায়েরা ভাবেন সন্তান অমনোযোগী। তার যে চোখে কোনও সমস্যা হচ্ছে, এটা আমরা চট করে ভাবি না। বাচ্চার মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে কি না সেটা স্কুলের শিক্ষক এবং বাবা-মা উভয়কেই নজর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে চোখ পরীক্ষা করিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা জরুরি।’’ অনেক সময়ে খেলতে গিয়েও সমস্যা ধরা পড়ে। বাচ্চাটি হয়তো বল ধরতে পারছে না, রিফ্লেক্স কম। ছোট বয়সে সমস্যা ধরা পড়লে চশমা ব্যবহার করে দৃষ্টিশক্তি ঠিক হয়ে যাওয়ার উদাহরণ অসংখ্য। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের সচেতনতা এবং সক্রিয়তাই আসল। ডা. অপূর্ব ঘোষ তাঁর একটি অভিজ্ঞতায় কথা বলছিলেন, ‘‘জনৈক বাবা-মা তাঁদের পাঁচ বছরের সন্তানকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন। আমি সাধারণ ভাবে পরামর্শ দিয়েছিলাম, একজন শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নেওয়ার। তাঁরা অবাক হলেও ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। পরীক্ষায় দেখা যায়, শিশুটির চোখের পাওয়ার মাইনাস ১৩! অথচ এত দিন সেটা বোঝা যায়নি। সে কারণেই তিন থেকে চার-পাঁচ বছর বয়সে একবার বাচ্চার চোখ পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি।’’ একদম ছোট থেকেই যে সব শিশুর চোখে পাওয়ার দেখা যায়, তার পিছনে কি নির্দিষ্ট কোনও কারণ রয়েছে? ‘‘এগুলো জন্মগত ত্রুটি। তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে ঠিক হয়ে যায়। কারও চোখের মণি একটু অন্য রকম হলে সেটাও চশমার মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই গুরুত্ব দেন না। লক্ষ্মী ট্যারা বলে এড়িয়ে যান,’’ মন্তব্য ডা. ঘোষের।
খেয়াল রাখুন
কারও চোখের সমস্যা জন্মগত, কারও লাইফস্টাইলের কারণে। সন্তান স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে চোখের সমস্যা হলে অভিভাবকেরা বুঝতে পারেন। তার আগেও কিছু কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যেতে পারে শিশুর চোখে সমস্যা হচ্ছে কি না—
• বারবার চোখ রগড়ানো, চোখ পিটপিট করা, জল পড়া।
• জোরালো আলোয় সমস্যা। কোনও কিছু দেখার সময়ে ভ্রু কুঁচকে থাকা বা আই ট্র্যাকিংয়ে সমস্যা।
• সরাসরি চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলা।
• প্রিম্যাচিয়োর ডেলিভারি হলে বা প্রেগন্যান্সির সময়ে মায়ের কোনও শারীরিক জটিলতা তৈরি হলে শিশুর চোখে সমস্যা হতে পারে।
আগাম যত্ন
আলাদা করে চোখের যত্ন নেওয়ার কথা বলছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে সমস্যার আভাস পেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। লাইফস্টাইলের কারণে চোখের যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়, তা কিন্তু সাবধান হলে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অর্থোঅপটিস্ট গার্গী চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘বাড়িতে অভিভাবককে খেয়াল রাখতে হবে শিশুর স্ক্রিন টাইম যেন বেশি না হয়ে যায়। মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ, চোখের খুব কাছে যেন ফোন না আনে। এখন যেহেতু অনলাইনে পড়াশোনা হচ্ছে তাই বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। টিভি দেখার সময়ে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।’’ টিনএজারদের অন্ধকার ঘরে ভিডিয়ো গেম খেলার প্রবণতা দেখা যায়। চোখের উপর বেশি চাপ পড়ে এতে। এই অভ্যেস বন্ধ করতে হবে।
একদম ছোট বয়সে পেডিয়াট্রিশিয়ান চোখের পরীক্ষা করতে পারেন। তবে বিশেষ কোনও অসুখ ধরা পড়লে শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। সন্তানের তিন-চার বছর বয়স নাগাদ একবার শিশু চক্ষু চিকিৎসককে দেখিয়ে নেওয়াও উচিত।