রাগ সহজাত প্রবৃত্তি। কোনও একটি পরিস্থিতি সাপেক্ষে এই আচরণের জন্ম। ব্যক্তিবিশেষে রাগের তারতম্য হয়। রাগ প্রকাশের ধরনও এক-এক জনের এক-এক রকম। তবে রাগ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে তা অনেক ক্ষেত্রেই দৈনন্দিন কাজে বাধা সৃষ্টি করে, সম্পর্কে তৈরি হয় অকারণ দূরত্ব।
করোনা অতিমারির কারণে সাধারণ মানুষকে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে জীবনযাপনের ‘নিউ নর্মাল’ ধারার সঙ্গে। একাধারে ঘরবন্দি দশা, অফিসের কাজের চাপ, অন্য দিকে জীবনধারার স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হওয়ায় রাগ-ক্ষোভ-বিরক্তি বেড়েছে মানুষের মধ্যে। তবে মাত্রাতিরিক্ত রাগ শরীর ও মনের পক্ষে ক্ষতিকর।
রাগ কেন হয়?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় রাগ হওয়ার তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করলেন:
• হতাশা: ‘ফ্রাস্ট্রেশন’ কথাটি আধুনিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে। তবে সাইকোলজিক্যাল পরিভাষায় এর ব্যাখ্যা হচ্ছে— মানুষ যে কোনও কাজই কিছু পাওয়ার আশায় করে। সেটা হতে পারে পুরস্কার, সম্মান বা এমন কিছু যা হয়তো বস্তুমূল্যের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ব্যক্তি যা প্রত্যাশা করছে, তা যদি পূর্ণ না হয়, তখনই জন্ম নেয় হতাশা। এবং তা থেকেই রাগের জন্ম।
• অন্যের আচরণের কারণে: মানুষ সব সময়ে নিজের আচরণের জন্য যে হতাশায় ভোগে, তা নয়। যেমন, কোনও মা হয়তো চাইছেন তার সন্তান ভিডিয়ো গেম কম খেলে পড়াশোনায় মনোযোগী হোক। কিন্তু সন্তান তা শুনছে না। তাই অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণ না পাওয়ার কারণেও রাগের জন্ম হতে পারে।
• বিপদের আশঙ্কা: কারও যদি মনে হয় তার অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে, পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাচ্ছে, তখন ব্যক্তি সেই পরিস্থিতি সাপেক্ষে রাগ দেখাবেই।
এগুলি রাগ হওয়ার সাধারণ কারণ। এর সঙ্গে মনস্তত্ত্ববিদ ডা. জয়রঞ্জন রাম জুড়লেন অতিমারি সম্পর্কিত কারণগুলি...
• অসহায়বোধ: করোনা, অতিমারি, লকডাউন, সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া... এই পরিস্থিতির উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই করোনা ও তা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা যখন মানুষের নেই, তখন মানিয়ে নিতে হবে। এই অসহায়তা থেকেও জন্ম নিচ্ছে রাগ।
• শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি: ওয়র্ক ফ্রম হোম কাজের ধারায় বেশি কাজ করতে হচ্ছে চাকুরিজীবীদের। তার সঙ্গে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে চিন্তা, সংসার-সন্তানের দায়িত্ব পালন... সব কিছু মিলিয়ে ক্লান্তিও বেড়েছে মানুষের। সেখান থেকেও রাগের জন্ম হতে পারে।
এ ছাড়া নিউরোলজিক্যাল ও সাইকোলজিক্যাল কারণেও সাধারণ মানুষের মধ্যে রাগ দেখা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে।
মাথার সামনের দিকে যে ফ্রন্টাল লোব থাকে, তা যে কোনও ধরনের আবেগের বহিঃপ্রকাশের নিয়ন্ত্রক। সেখানে কোনও সমস্যা হলে রাগের বহিঃপ্রকাশেও সমস্যা বাড়বে।
• মাথায় আঘাত: ব্রেন ইনজুরি যদি গুরুতর হয়, তবে সেখান থেকে রাগের মতো আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
• এপিলেপ্সি, ব্রেন স্ট্রোক: এই ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা ও পরিস্থিতির ক্ষেত্রে রাগ বশে রাখতে সমস্যা হয়।
• পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার: ছোটবেলা থেকে কোনও হেনস্থার শিকার হলে, তা মানসিক গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। সেখান থেকে রাগের জন্ম হয়। কোনও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে, অসময়ে প্রিয়জনের বিয়োগ হলেও ব্যক্তির মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাগের জন্ম হয়।
• দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস: সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই কারণগুলোই বেশি দেখা যায়। তবে স্ট্রেস যদি অসুখের আকার নেয় এবং তা ডিপ্রেশনের দিকে এগোতে থাকে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া দরকার।
রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায়:
সাইকোলজিক্যাল পরিভাষায় একে বলা হয় ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট’। তবে রাগ নিয়ন্ত্রণের আসল জাদুমন্ত্র রয়েছে মানুষের হাতেই।
• চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনা জরুরি। ব্যক্তি বা পরিস্থিতির উপরে কোনও মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই যে ব্যক্তি বা পরিস্থিতির কারণে রাগের জন্ম, তাকে বদলানো না গেলে নিজের মধ্যেই পরিবর্তন আনতে হবে। ওই পরিস্থিতির সঙ্গে কী ভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, তা ভাবতে হবে।
• কেন রাগ হচ্ছে, সেই কারণগুলো আগে থেকেই বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এবং সেইমতো ব্যক্তি তার আচরণ ও প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তন আনবে।
• মনের মধ্যে ক্ষোভ জমিয়ে না রেখে তা প্রকাশ করা খুব জরুরি।
• রাগের উপলক্ষকে দূরে সরাতে চেষ্টা করুন। যে মুহূর্তে মনে হচ্ছে রাগ হতে পারে, সেই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিন।
• ব্যায়াম, প্রাণায়াম, যোগাসনের মাধ্যমে একাগ্রতা বাড়াতে চেষ্টা করুন।
• ঘুমের সাইকেলে ব্যাঘাত হলে রাগ বাড়ে। তাই শত কাজের মধ্যেও সেই সাইকেল ঠিক রাখতে হবে।
• নিজের কাজ ও আপনার চারপাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কাজের আগাম একটা রূপরেখা নির্ধারণ করা, যাতে কাজে অসুবিধে না হয়।
• দিনের কিছুটা সময় নিজের জন্য বার করা। ওই সময়ে আপনি নিজের মতো করে সময় কাটান।
জীবনের যে কোনও পরিস্থিতিতে রাগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা যেন আপনার বা অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়, সেটা দেখাও আপনার দায়িত্ব।