মেট্রোয় এক মা— ‘‘কাল ছেলেকে অফিস থেকে ফোন করে বললাম, হোমওয়র্কটা করে রাখ, গিয়ে দেখব। ফিরে দেখি তিনি কার্টুন দেখছেন। পড়াশোনায় একদম মন নেই।’’ অন্য মা— ‘‘আমার ছেলেও তা-ই। সামনে না বসলে পড়বে না।’’ পাশের সহযাত্রীর ফুটনোট— ‘‘আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল, পড়ার সময়েই ওর জলতেষ্টা, টয়লেট পাবে, হাতে ব্যথা করবে...’’
খুদেদের নানাবিধ অমনোযোগিতার বর্ণনা শুনতে বেশ মজা লাগে। পড়ার সময়ে একটুও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবে না, আঁকতে বসে টেডিগুলোর গায়ে রং করে দেবে না— এমন বাচ্চা বোধহয় ভূ-ভারতে নেই। তবে, অমনোযোগিতারও কম-বেশি থাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম জানালেন, ‘‘বাচ্চার বয়স কত, তার উপরে নির্ভর করবে তার মনোযোগ। ৪-৫ বছরের বাচ্চা ও ৮-১০ বছরের বাচ্চার মনোযোগ এক হবে না। মনোযোগ বাড়াতে হবে অভ্যেসের মাধ্যমে। সন্তানকে প্রথম দিনেই টানা দু’ঘণ্টা পড়তে বসালে সে বসবে না। সে ক্ষেত্রে প্রথম এক সপ্তাহে আধ ঘণ্টা তাকে পড়তে বসাতে হবে। ধীরে ধীরে সেই সময়সীমা বাড়াতে হবে। সন্তানের মনোযোগ কম না বেশি, তা মা-বাবা সব সময়ে বুঝতে পারেন না। সেটা তার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন।’’ তবে ছোট থেকে কিছু অভ্যেস তৈরি করে দিলে অমনোযোগিতাকে অনেকটাই বাগে আনা যায়। কেমন করে, দেখে নেওয়া যাক।
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ জানালেন, তিন থেকে ছয় বছরের বাচ্চাদের মনোযোগের সমস্যা কাটাতে প্রধানত পাঁচটা বিষয়ের উপরে জোর দিতে হবে।
ঘাম ঝরুক
রোজ অন্তত এক ঘণ্টা ছোটাছুটি করে খেলার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। এতে ঘাম ঝরবে। ফলে শরীরে এনডরফিন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হতে থাকে। এর পরেই বাচ্চাকে পড়াতে বসালে প্রথম ঘণ্টাখানেকের পড়ায় ওর পুরো মনোযোগ থাকবে।
ইন্ডোর গেমস
এখন প্রচুর ইন্ডোর গেমস, বই পাওয়া যায়, যা বাচ্চার কগনিটিভ স্কিল বাড়ায়— যেমন নানা ধরনের অ্যাকটিভিটি বুক, বিল্ডিং ব্লকস, পাজ়লস ইত্যাদি। স্মার্টফোনের বদলে এই ধরনের খেলা বা বই ওর হাতে তুলে দিলে মনোযোগের সমস্যা অনেকটাই কমে। সন্ধেবেলা পড়ার মাঝে একটু বিরতি নিয়ে কিছুটা পাজ়ল সলভ করলে বা বিল্ডিং ব্লকস নিয়ে খেললে কখনও মনোযোগে ঘাটতি পড়ে না আর ওদের একঘেয়েমিও কাটে।
মিউজ়িকে মন বসে
ছোট থেকে ওকে মিউজ়িক ইনস্ট্রুমেন্টে তালিম দিতে পারেন। বিদেশে অনেক জায়গায় আড়াই বছর বয়স থেকে পিয়ানো শেখানো হয়। অতটা সম্ভব না হলে তবলা, মাউথ অর্গ্যান, সিন্থেসাইজ়ার— যে কোনও একটি বাজনা শেখাতে পারেন। নোট ধরে সুর তোলার মধ্য দিয়ে কনসেনট্রেশন লেভেল অনেকটাই বাড়ে।
গল্প বলা
শোওয়ার আগে কিছুটা সময় থাক গল্প বলার জন্য। অভিনয় করে গল্প বললে ওরা আগ্রহী হবে। গল্পের মাঝেই ওকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে। এতে খুদে শ্রোতাটির ধৈর্য ধরে শোনার প্রবণতাও তৈরি হয়। মনোযোগ বাড়াতে গল্প শোনানোর ভূমিকা বিরাট। সে গল্প শুনছে কি না, তা বুঝতে আপনিও পরে গল্পের মধ্য থেকে প্রশ্ন করে যাচাই করে নিতে পারেন।
ছোট নির্দেশ
লেখার সময়ে ওকে ছোট ছোট নির্দেশ দিন। প্রথমে তিনটে দিয়ে শুরু— যেমন ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ‘পয়েন্টগুলোকে জুড়ে দাও, রং দিয়ে আউটলাইন টানো, ভিতরটা রং করো।’ আস্তে আস্তে নির্দেশের সংখ্যা বাড়াতে থাকুন আর দেখুন ও কতটা মনে রাখতে পারছে। বাড়িতে নির্দেশ মতো ঠিকঠাক কাজ করার অভ্যেস গড়ে তুললে স্কুলেও শিক্ষকদের নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না।
অঙ্কের কেরামতি
পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘ক্লাস ওয়ানে ওঠার পরে অর্থাৎ মোটামুটি ছয় বছর থেকেই বাচ্চাকে নিয়মিত খেলাধুলোর সঙ্গে রোজ কিছুটা সময় ধরে অঙ্ক কষার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। অঙ্ক মানে শুধুই সিলেবাসের বাঁধা গতের অঙ্ক নয়। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বইয়ের অঙ্কও কষতে হবে, অনেকটা ধাঁধার সমাধান করার ঢঙে। মনোযোগ বাড়াতে অঙ্কই হয়ে উঠতে পারে তুরুপের তাস।’’ সম্প্রতি এক গবেষণা বলছে, দিনে অন্তত দশটা নানা ধরনের অঙ্ক যদি একটা বাচ্চা কষতে পারে, তা হলে অজানা কিছু সমাধানের ক্ষেত্রে তার মনোযোগ অনেকটা বেড়ে যায়। পরবর্তী জীবনেও বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই এগিয়ে থাকবে। আবার কোনও বাচ্চার যদি অঙ্কেই আতঙ্ক থাকে! সে ক্ষেত্রে পড়তে বসে প্রথমে অঙ্ক করে, পরে তার প্রিয় বিষয় যেমন, ভূগোল বা ইতিহাস পড়াতে পারেন। পড়ার প্রথম দিকে মনোযোগ বেশি থাকে। তাই প্রথমেই অপছন্দের বিষয় পড়ে ফেলতে হবে। বরং শেষের দিকে থাকুক প্রিয় বিষয়।
খেলার ছলে
সব সময়ে পড়তে বসিয়ে বা আঁকতে বসিয়ে মনোযোগ বাড়ানো যায় না। সে ক্ষেত্রে ছোট ছোট খেলা খেলতে পারেন। ডা. জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘ধরুন, আপনি বাজার করতে গিয়েছেন। সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যান। ওকে বলুন বাজারে যত লাল অবজেক্ট দেখতে পাচ্ছে, সেগুলো গুনে আপনাকে বলতে। আবার কোথাও হয়তো বেড়াতে যাচ্ছেন, বাচ্চাকে বলুন দুই দিয়ে শেষ হওয়া ক’টি গাড়ির নাম্বারপ্লেট সে দেখতে পেল, আপনাকে গুনে জানাতে।’’ এতেও সন্তানের মনোযোগ বাড়বে।
মা-বাবার দায়িত্ব
বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন। আর ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। মা-বাবা ধীরস্থির হয়ে, মন দিয়ে বাচ্চার কথা শুনলে স্বভাবতই ওর অতিরিক্ত ছটফটে ভাব কমে আসবে।
ওর হোমওয়র্ক ওকেই করতে দিন। স্কুলে বকুনি খাওয়ার ভয়ে নিজেরা করে দেবেন না। এতে ও পড়ার গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
সন্তানের বয়স বারো-চোদ্দো বছর হলে তার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। পড়ানোর সময়ে টাইমার ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিটি টাস্কের সময় বেঁধে দিন। সময়ের মধ্যে তা শেষ করার অভ্যেস হলে পরীক্ষায় সুবিধে হবে।
বাচ্চাদের সামনে টেনশন করবেন না, আতঙ্কে ভুগবেন না। ওর সামনে অন্তত মনের ভাব চেপে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। না হলে ওর মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা জন্ম নেবে। বাড়ির পরিবেশ যদি শান্ত স্বচ্ছন্দ থাকে, বাচ্চার স্বভাবেও তার প্রভাব পড়ে।
মডেল: হিয়া মুখোপাধ্যায়, রোমিত বন্দ্যোপাধ্যায়;
ছবি: অমিত দাস;
মেকআপ: সৈকত নন্দী ;
লোকেশন: লাহাবাড়ি;
পোশাক: ওয়েস্টসাইড, ক্যামাক স্ট্রিট