প্রতীকী ছবি
এ কেমন পুজো? নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে, মণ্ডপে অধিষ্ঠাত্রী জগজ্জননী। তবু তাঁর সন্তানদের ঘরে নিরানন্দ। কারও চাকরি চলে গিয়েছে, কেউ রোজগার হারানোর আশঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত। ভাইরাসের আতঙ্কে কারও স্বজন ঘরে ফেরেননি, কারও আপনজন হাসপাতালের বিছানায়। কারও সুখবাসরে কালনাগিনী হয়ে ঢুকেছে ২০২০। তার বিষে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন প্রিয়জন। আজ এত রোশনাইয়ে আরও গাঢ় সেই মনের আঁধার। বিষাদসিন্ধু পেরিয়েও উৎসবের দিন ক’টায় একটু ভাল থাকার, শান্তির খোঁজ মিলতে পারে— যদি, সকলে মিলে সেই আয়োজনেই মন দিই।
নতুন করে পাব বলে
কর্মস্থলে অনিশ্চয়তা থাকলেও, পুজো থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। এতে গোটা পরিবার কষ্ট পাবে। পুজো অর্থনীতির অবলম্বন। তাই সংযম থাকুক, কিন্তু পুজোকেন্দ্রিক ব্যবসার চাকাটি থামতে দেবেন না। দামি জামাজুতো না দিতে পারলে দরকারি কিছু ছোটখাটো উপহার কিনুন প্রিয়জনদের জন্য। মন শান্ত করতে কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে গ্রামবাংলার শান্ত রিসর্টে সময় কাটিয়ে আসতে পারেন। স্থান পরিবর্তনে মন ভাল থাকে। সোশ্যাল সাইটের হইচই এড়িয়ে বছরের সেরা সময়টা দিন কাছের মানুষগুলোকে। ওরা একচিলতে হাসলেও আপনি অনেক ভারমুক্ত থাকবেন।
দূরের স্বজনদের অনলাইনে উপহার পাঠাতে পারেন। কাছের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ না থাকলে ভার্চুয়াল আড্ডা দিন। ক্ষণিকের তরে হলেও, মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার নিয়ে দূরত্ববিধি মেনে পুজোমণ্ডপের দিকে যেতে পারেন। মণ্ডপের আলোয় একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও মন হালকা হবে। ঢাকির কাছ থেকে ঢাক চেয়ে একটু বাজাতেও পারেন। খাবার কিনলে অন্যদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে খেতে পারেন। ক্রেতা-দর্শনার্থীর অভাবে ই-গেম আর এমপিথ্রি কাঁসরঘণ্টা পুজোকে কব্জা করলে এই মানুষগুলির দুর্দশার সীমা থাকবে না। একে অপরের পাশে দাঁড়ালেও যন্ত্রণা একটু কমবে বইকি!
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
প্রিয়জনের বিয়োগব্যথার ক্ষতকে ব্যস্ততার ব্যান্ডেজে মুড়ে রাখা যায়। শোকের আবহে আমোদের প্রবৃত্তি থাকে না। পরিবর্তে অনাথালয়, বৃদ্ধাশ্রমে পুজোর দিন কাটাতে পারেন। পোশাক, সিনেমা, সুখাদ্যের আয়োজন করে তাঁদের অপ্রাপ্তি, একাকিত্ব মুছে দিন। এঁদের ভালবাসার স্পর্শ আপনার যন্ত্রণায় কিছুটা হলেও প্রলেপ দেবে। মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের মতে, ‘‘উৎসবটা ‘স্পিরিচুয়ালি’ উদ্যাপন করুন, শান্তি পাবেন। প্রয়াত মানুষটির ভাল স্মৃতিগুলি মনে করুন, সেগুলিকে সম্মান দিন।’’ জেঠু ষষ্ঠীতে বাগবাজারের ঠাকুর দেখাতেন। সে দিন আপনিই ভার্চুয়ালি প্রতিমা দর্শনের ব্যবস্থা করুন। দশমীর সন্ধেয় দিদিমার মতো করে রসগোল্লা, নিমকি সাজিয়ে দিন প্রত্যেকের প্লেটে। অন্যদের মনে হবে, মানুষগুলি যেন আপনার মধ্যেই বেঁচে আছেন। বিচ্ছেদবেদনা বয়স্কদেরই বেশি। পুজোয় তাঁদের সঙ্গে থাকুন, মন ভোলানোর ব্যবস্থা রাখুন। স্মার্টফোন, কুকুরছানা এনে দিন। সন্তপ্ত পরিবার অন্য কিছু আঁকড়ে পুজোর দিনগুলো উপভোগ করবে। নয়া পারিবারিক প্রথা শুরু করুন। দু’-এক জন মামা-মাসি-পিসিকে ডেকে নবমীর দিন একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে দেখুন। নতুন প্রজন্মকে দায়িত্ব নিতে দেখলে মানুষগুলো স্বস্তি পাবেন। আপনারও অদ্ভুত তৃপ্ত লাগবে।
পরিশ্রান্ত মনকে বিশ্রাম দিন। বাইরে বেরোতে ইচ্ছে না হলে, ঘরে বসে আইপিএল-সিনেমা-গান-সাহিত্যে দিনগুলো কাটান। এ বাবে হৃদয়ের শূন্য ভাবটা একটু হলেও কিন্তু জুড়োবে।
তোমার সঙ্গে বেঁধেছি প্রাণ
বিপর্যস্ত মানুষগুলির পাশে থাকার আবেদন জানালেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘প্রতি বারই পুজোয় স্বজনবিচ্ছেদ বা দুঃসময়ের কষ্টটা কিছু মানুষ পান। এ বার বিপর্যয় সামগ্রিক। অসময়ের শোক বহু ঘরে। তাই উৎসবের সুর যেন উচ্চকিত না হয়। এতে অনেকের সংগ্রাম উপেক্ষিত হবে, মানুষগুলির একা লাগবে। যে পাড়ায় অনেক বাড়িতে বিপদ, সেখানে মাইক-আলোর বাড়াবাড়ি না করার সংবেদনশীলতাটুকু রাখুন। আত্মকেন্দ্রিক বিনোদনের ঊর্ধ্বে গিয়ে, মানবিক ভাবে পাশে থাকুন। অভাবের তাড়নায় কোনও পরিবার হয়তো হোম ডেলিভারি চালু করেছেন। পুজোর দিনে এঁদের থেকে নিরাপত্তাবিধি মেনে খাবার আনাতে পারেন। উৎসব পালনের মাধ্যমেই তাঁদের সহযোগিতা করা যাবে। এ ভাবেই সমবেত ভাবে ভাল থাকার উপায় খুঁজতে হবে।’’
হয়তো সেই অহংনাশী মানবধর্মের হৃদয়াঞ্জলিতেই ত্রিনয়ন মেলবেন দুর্গতিহারিণী। আর ঠিক এসে পড়বে করোনার বিজয়া দশমী।