আত্মহত্যাও কি সংক্রামক? একের থেকে অন্যের মধ্যে ছড়াতে পারে কি আত্মহত্যার প্রবণতা?
পল্লবী দে, বিদিশা দে মজুমদার, মঞ্জুষা নিয়োগী। নামগুলি পরপর ঘোরাফেরা করছে মনের মধ্যে?
এমন অনেকেরই হচ্ছে। মাত্র দিন কয়েকের ব্যবধানে উদ্ধার হয়েছে এই তিন অভিনেত্রী ও মডেলের দেহ। রবিবার সেই তালিকায় যুক্ত হয় উঠতি মডেল সরস্বতী দাসের নাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের অনুমান, ঘটনাটি আত্মহত্যা।
পল্লবীর মৃত্যুর পর থেকেই চলছে এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা। কেউ বলছেন, বিনোদন জগতের সঙ্গে যুক্তদের মনের অবস্থা এমন হয়, কেউ বা মনে করে এ সব এই প্রজন্মের সমস্যা। সে তো গেল ব্যক্তিগত ধারণা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে আত্মহত্যা বাড়ছে এ দেশে। এ বছরের মার্চে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ দেশে বছর বছর বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। ১৯৭৮ সালে প্রতি ১ লক্ষে ঘটত ৬.৩টি আত্মহত্যা। ২০২০ সালে তা-ই বেড়ে হয়েছে ১১.২৫। সেই রিপোর্টে আরও একটি বিষয় নজরে এসেছে। আর্থিক ভাবে এগিয়ে থাকা কোনও দেশের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এ দেশের মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা। তা দেখে সতর্ক হওয়ার প্রসঙ্গ এমনিতেই ওঠে। কিন্তু পরপর এতগুলি এমন ঘটনা আরও একটি প্রসঙ্গও তুলছে।
আত্মহত্যাও কি সংক্রামক? একের থেকে অন্যের মধ্যে ছড়াতে পারে কি আত্মহত্যার প্রবণতা?
এ নিয়ে সাধারণের মধ্যে সচেতনতা কম থাকলেও মনোবিদরা সচেতন। একটি আত্মহত্যার ঘটনা যে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা উস্কে দিতে পারে, সে কথা নেটমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়ে মনে করিয়েছেন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘এ রকম বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে, যেখানে একটি মৃত্যুর ঘটনা আরও কয়েকটি ঘটনাকে উস্কে দিয়েছে। একই সময়ে পরপর অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার যথেষ্ট তথ্য রয়েছে।’ ফলে তাঁর মত, আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করার সময়ে থাকতে হবে সচেতন। বিশেষ করে গণমাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়ে কী কথা বলা হচ্ছে, তা সচেতন ভাবে পরিবেশন করা জরুরি বলেই মত প্রকাশ করেছেন তিনি।
শহরের আর এক মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব অনেকটাই একমত এই বক্তব্যের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, আত্মহত্যা নিয়ে গণমাধ্যমে বেশি আলোচনা হলে তা অনেকের মধ্যে ছড়ায়। এবং ছোঁয়াচে রোগের মতো বাড়ে আত্মহত্যার প্রবণতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আগেও বহু বার দেখা গিয়েছে, গণমাধ্যমে আত্মহত্যা নিয়ে বেশি কথা হলে তাতে বেড়ে যায় আত্মহত্যার ঘটনা। একের পর এক ঘটনার রিপোর্ট যত ছড়ায়, ততই যেন বা়ড়তে থাকে নতুন ঘটনার সংখ্যা। এ নিয়ে নানা সমীক্ষা হয়েছে। গবেষণাতেও দেখা গিয়েছে, বিষয়টি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে এ শুধু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সত্যি, তা নয়। বহু অপরাধেই এমন দেখা যায়। গণমাধ্যমে যদি বেশি কোনও এক ধরনের অপরাধের কথা লেখা বা দেখানো হয়, তা আরও বাড়তে দেখা গিয়েছে আগেও। আবার যখন অন্য ধরনের ঘটনা নিয়ে বেশি খবর প্রকাশ হতে শুরু করেছে, তখন খানিকটা কমতে শুরু করে সেই ধরনের অপরাধের সংখ্যা।’’ ফলে অনিরুদ্ধর মতে, গণমাধ্যমে কী ভাবে কোন ঘটনা প্রকাশ করা হচ্ছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ আত্মহত্যা হোক বা কোনও ধরনের অপরাধমূলক কাজ— সবই ছোঁয়াচে। এক জনকে দেখে অন্যের মধ্যে সে প্রবণতা বাড়ে।
প্রতীকী ছবি।
তবে এমনও নয়, একটি আত্মহত্যার ঘটনার কথা সংবাদমাধ্যমে শোনা মাত্র যে কেউ আত্মহত্যা করবেন। যাঁর মধ্যে ইতিমধ্যেই জীবন নিয়ে সঙ্কট রয়েছে, বিপন্নতা রয়েছে, তাঁর ক্ষেত্রে হয়তো আর এক জনের আত্মহত্যার খবর উস্কানিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনই মত মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপের। অনুত্তমা বলেন, ‘‘দু’ভাবে হয় সুইসাইড কনট্যাজিয়ন। একটি ক্ষেত্রে হয় পরিচিত কেউ মারা গিয়েছেন। বা পরিচিত কারও থেকে জানতে পেরেছেন কারও মৃত্যুর কথা। সেই খবর এক জনের মনের মধ্যে উস্কে দিতে পারে আত্মহত্যার ইচ্ছা। আর একটি হয় সংবাদমাধ্যমে কোনও খবর জানতে পারলাম, তার পর নিজের বিপন্নতা থেকে মুক্তির পথ হিসাবে আত্মহত্যার কথা আবারও মনে এল। এবং আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই আমরা এমন বলতে পারি না যে, কোনও সঙ্কট, কোনও বিপন্নতা ছিল না, শুধুমাত্র কারও খবর মৃত্যুসংবাদ শুনেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু সঙ্কটে থাকলে, অন্যের আত্মহত্যার কথা জেনে তিনি তাঁর সঙ্গে একাত্ম বোধ করলেন।’’
সংবাদমাধ্যম থেকেই আত্মহত্যার মতো ঘটনার খবর বেশি ছড়ায়। অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছয় বলে মত প্রকাশ করেন অনিরুদ্ধ। ফলে একটি সময়ে যদি আত্মহত্যার প্রবণতা ছড়াতে দেখা যায়, তবে সতর্ক হতে হবে সংবাদমাধ্যমকে।
তবে কি একই সময়ে পরপর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকলে সে সংবাদ পরিবেশন করা বন্ধ করতে হবে? খবর চেপে রাখায় বিশ্বাসী নন অনুত্তমা। তেমনটা দাবি করছেন না অনিরুদ্ধও। তবে সচেতনতার কথা বলছেন। অনুত্তমার পরামর্শ, ‘‘এ ধরনের খবর প্রকাশ করার সময়ে ট্রিগার অ্যালার্ট দিতে পারে মিডিয়া। তার সঙ্গে যদি কিছু ইতিবাচক খবরও প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম, তা হলে বোধ হয় খানিকটা সামাল দেওয়া যেতে পারে এই সমস্যা। অর্থাৎ, এই যে এখন বলা হচ্ছে গ্ল্যামার জগতে অনেক লড়াই, সে সঙ্কট সামলাতে না পেরেই একের পর এক অভিনেত্রী আত্মঘাতী হচ্ছেন। সেটিই একমাত্র চিত্র নয়। এর উল্টো ছবিটাও যদি দেখানো যায়, যাঁরা সঙ্কট সামলে ভাল আছেন, তাঁদের কথাও বলতে পারে সংবাদমাধ্যম। তা হলে মৃত্যু বা আত্মহত্যার ব্যাখ্যায় এই অতিসরলিকরণ বোধ হয় কিছুটা এড়ানো যাবে।’’ সকলের সমস্যা যে এক নয়। একই কারণে সকলে আত্মহত্যা করছেন ভাবলে মনে হতে পারে, যাঁদের কারণ এক, তাঁদের জন্য সমাধানও বোধ হয় একই হবে। এই ভাবনাকেও কোথাও চ্যালেঞ্জ করা দরকার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আনন্দবাজার অনলাইন ইতিমধ্যেই আত্মহত্যার খবর ‘ট্রিগার অ্যালার্ট’ দিয়ে পরিবেশন করা শুরু করেছে। হ্যাশট্যাগ দিয়ে যাচ্ছে সেই অ্যালার্ট।
প্রতীকী ছবি।
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ঘটনা মনে করান মনো-সমাজকর্মী মোহিত। তিনি জানান, লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়ে গীতিকারের মৃত্যুর কিছু দিন পর একই ভাবে একই জায়গায় আর এক মহিলা আত্মহত্যা করেন। সে সময়ে তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। তেমনই চন্দননগরে একটি পাড়া আছে যেখানে বহু বাসিন্দা আত্মহত্যা করেছেন। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা যে ছোঁয়াচে, সে সংক্রান্ত তথ্যের অভাব নেই। তবে সকলেই কি সমস্যায় পড়লে আত্মহত্যা করেন, এমন তো নয়। সে খবর যে ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পর তার পরিস্থিতির ব্যাখ্যা ছাড়াই ছড়িয়ে যায় শুধু খবরটি। কিন্তু কারণটি জানতে পারলে হয়তো অন্য ভাবে দেখতেন সেটি।’’ এই দিকটিও খবর প্রকাশ করার সময়ে এবং খবর পড়া বা দেখার সময়ে মনে রাখা জরুরি বলে মত মোহিতের। তা হলেই হয়তো আত্মহত্যার খবর মানেই ততটা উস্কানিমূলক মনে হবে না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।