Relationship

Relationship: জীবনের হাত ছাড়ার চেয়ে সম্পর্কের হাত ছাড়া বরং অনেক ভাল

সম্পর্ক চিরন্তন হলে হয়তো আরাম হত। কিন্তু সে সম্পর্ক একমাত্র সম্ভব নিজের সঙ্গে। নিজের সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তোলায় কোনও শ্রমই দিই না আমরা।

Advertisement

সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২২ ১৮:৩৩
Share:

আমিও কিন্তু মৃত্যুকেই কাঙ্ক্ষিত ভেবে সে দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছি বেশ কয়েক বার। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

‘এত আনন্দ আয়োজন, সবই বৃথা আমায় ছাড়া…’ গানটা প্রায়ই শুনি। যেমন শুনি অনেক গানই। চুপ করে বসে থাকি জানলার বাইরে তাকিয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে এক মুহূর্তের জন্য যে ভাবনা আমাকে ছেড়ে যায়নি, তা তো ‘মৃত্যু’ই। ছোটবেলায় মাকে জড়িয়ে ধরতাম কেবল এই ভয় থেকে যে এক দিন আমি থাকব না?

Advertisement

সেই ‘না থাকা’ কে বুঝতে চেয়ে আকুলিবিকুলি করে উঠত মন। মা বলত, ‘‘তোমার এ সব মনে হয় যখন দেখবে, খুব অন্য রকমের একটা জীবন ধরা দেবে তোমার কাছে। তুমি অন্য রকম হবে।’’ সেই অন্য রকমকে এক বার চেখে দেখবার লোভে মায়ের বুকের ভিতর মাথা ডুবিয়ে ভুলে যেতে চাইতাম সেই সব ভাবনাকে।তবু সেই ভাবনা আমাকে ধাওয়া করত। বাসে, স্কুলে, রাস্তায়, বন্ধুদের হইহইয়ের মধ্যে হঠাৎ-হঠাৎ অবশ লাগত আমার। তবু সেই বোধকে বয়ে নিয়েই আমার এত দূর হেঁটে আসা। শঙ্খ ঘোষ এক বার বলেছিলেন, ‘‘মৃত্যুকে উপলব্ধি করার মানে তুমি সত্য দর্শন করছ, তাকে ভয় পেও না।’’ তাতে খানিক শান্ত লেগেছিল আমার। কিন্তু যে আমি ভয় পেয়েছি মৃত্যুকে, না থাকার বোধকে, যে আমি অন্য রকম জীবন এক বার বেঁচে দেখতে, চেখে দেখতে চেয়েছি, সেই আমিও কিন্তু মৃত্যুকেই কাঙ্ক্ষিত ভেবে সে দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছি বেশ কয়েক বার।

সেই অনুভূতি, সেই বোধ, সেই শূন্যতা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। একটা সময় প্রতিটা দিন আমার শূন্য মনে হত। এই পৃথিবীর এক জন মানুষের কাছেও আমার কোনও আরাম ছিল না। কারণ কি ছিল না কোনও তার? ছিল। মানবজন্মে যেমন বহু কারণ থাকে মন মরে যাওয়ার। কিন্তু মন সত্যি-সত্যি মরে গেলে আসলে হরমোনের গোলমাল বাধে অনেক। কিন্তু আমরা তখন মন নিয়ে এমন হিমসিম খাই যে, হরমোনের কথা আলাদা করে মনে পড়ে না আমাদের। পড়লে হয়তো এক বার ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়াও যেত। যেমন আমি গিয়েছিলাম। আমার মতো শান্ত আপাত অর্থে ভারী সংসারী একটি মেয়ে, যে একটু কবিতা-সিনেমা লেখেটেখে, সেই আমি এক দিন ভরা লকডাউনে ছাদের পাঁচিলের উপর উঠে বসে ছিলাম। চুপ করে আকাশ আর মাটি দেখছিলাম।

Advertisement

যখন সম্বিত ফিরল, তখন সেখান থেকে নামতেই ভয় করছে। নীচের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু সে দিন আমি বুঝতে পারলাম, এই নিয়ে দুটো কবিতা হয়তো আমি লিখতে পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার যা দরকার, তা হল ডাক্তার। কোথাও কি সেই সব সতর্কবাণী কাজ করেনি মাথার ভিতর? এক অগ্রজ কবি বলেছিলেন, ‘‘তোমার অন্য রকম একটা মন আছে। কোনও দিন কিন্তু তার জন্য ডাক্তার দেখিও না। তা হলে আর কবিতা লিখতে পারবে না।’’

এ কথাও সত্যি যে, বহু দিন সে ভাবে কবিতা লিখতে পারছি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তার সঙ্গে সুস্থ থাকার কোনও বিরোধ নেই। একটা সুস্থ মনও কল্পনাপ্রবণ হতে পারে। হ্যাঁ, হয়তো আপাত হরমোনের ভারসাম্য কিছু বিষাদ, অস্থিরতা যা হয়তো কোনও কোনও কবিতার গর্ভ ছিল, সে সব কমিয়ে দেয়। কিন্তু আমি জানি সেই কমে যাওয়ার আরাম। অস্থিরতাহীন এক রাত্তির শান্তির ঘুমের মূল্য। আত্মহত্যার প্রবণতাহীন একটা জীবন কাটানোর আরাম।

কিন্তু কেন এত আত্মকথন? কেন এমন সব কথা লিখে ফেলা, যা কখনও কোথাও লিখিনি? কারণ, সাম্প্রতিক সময় একের পর এক আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। আর আমরা তা নিয়ে বিচারসভা বসাচ্ছি। তাই আমি এ লেখা ‘আমি’ দিয়ে শুরু করলাম। যাতে আর যাই করি, নিজের জীবন শেষ করে ফেলার মতো অল্পবয়সি কতগুলো বিষাদগ্রস্ত মেয়েকে আমি বিচার না-করে ফেলি। যারা চলে গেল, তারা তো পড়তে পারবে না এ লেখা। তাই তাদের জীবন কাটাছেঁড়া করে আমার লাভ নেই কোনও। তাদের পরিবার এই শোক সহ্য করার শক্তি পাক, এইটুকুই আমার কামনা। এ লেখা তাদের জন্য, যারা এই পৃথিবীতে আছে। কষ্টে, বিষাদে, আত্মহত্যা প্রবণতায়।

মানুষ কষ্ট পায় না-পাওয়ায়। আর সেই না-পাওয়া যেমন আসতে পারে পার্থিব বহু জিনিসে, তেমনই আসতে পারে সম্পর্ক থেকে। আমার জীবনে পার্থিব জিনিসের মোহ কম থাকলেও আমি আন্দাজ করতে পারি যে, আজকের যুগে যখন ঝাঁ-চকচকে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র সুখের প্রদর্শন হিসেবে হাজির হয়েছে, তখন সেই আলো-আলো বেঁচে থাকার লড়াইটা ঠিক কত কঠিন হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নানান রকম ‘রিল’-এ মানুষ নাচছেন, সর্বদা হাসিমুখের ছবি পোস্ট হচ্ছে। যে সব বিয়ে মরে বেঁচে আছে, তারা সুখী দম্পতির ছবি আপলোড করছে। আর কিছু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে কষ্ট পেতে পেতে ভাবছে, ‘একা আমারই কিছু নেই? কেউ নেই?’

আমার খুব ইচ্ছে করে, তাদের দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলি, এই পৃথিবীতে কারওরই কিছু নেই। কেউ নেই। এ সব হল ধারের জিনিস, ধারের মানুষ। এক জন্মের জন্য ধার নিয়েছি আমরা, ফেরত দিয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু তবু জীবন সুন্দর। কারণ, জীবন একটা চেতনার প্রাপ্তি। মারা যাওয়ার পর যে চেতনাটা নিভে যাবে। এই আকাশ, এই গাছ, সভ্যতার ফলস্বরূপ এই বাড়ি, এই রাস্তা আর কিচ্ছু দেখতে পাব না আমরা। নিভে যাব। কিন্তু আজ যখন জ্বলে থাকবার সুযোগ পাচ্ছি, কোনও মূল্যেই নিজে নিজে নিভব না। ভালবাসা আমাদের কষ্ট দেয় ঠিকই, কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে ভালবাসার থেকে অনেক বেশি কষ্ট দেয় ভালবাসার সামাজিকতা। কিন্তু তার পরেও, ভালবাসতে কি অপূর্ব লাগে না?

ডোপামিন আর নরেপিনেফ্রিন হরমোন শরীরের ভিতর বেশিমাত্রায় ছুটোছুটি শুরু করলে আমরা বুঝতে পারি, আমরা ভালবেসে ফেলেছি। ঘুম চলে যায়। লোকে জিজ্ঞেস করে ‘ইনসোমনিয়া?’ আমরা বুঝতে পারি ‘ভালবাসা’, ‘প্রেম’। তার পর এক দিন সেই প্রেম, সেই ভালবাসাই এত কষ্ট দেয় আমাদের? কী হয়? যা পেতে চাই, যে ভাবে পেতে চাই তা আর পাই না সেই সম্পর্কে? যদি না-ই পাই, ছেড়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ তো রইলই। সম্পর্কের হাত ছাড়া বরং অনেক ভাল, জীবনের হাত ছাড়ার চেয়ে। কিন্তু সম্পর্কের হাত ছাড়তে গেলে যদি খুন হয়ে যেতে হয়?

বহরমপুরের সুতপা চৌধুরীর খুন সে কথা আমাদের ভাবিয়েছে বার বার। আসলে সম্পর্ক চিরকালই বোধহয় আর পাঁচটা পার্থিব জিনিসের মতোই ছিল। যে ভাবে টাকা দিয়ে কিছু কিনে নিলে আমরা ভাবি সেই জিনিসটা আমার, একদম আমার। সেটা অন্য কেউ নিলে তাকে ‘চুরি’ করা বলি। আমরা সম্পর্ককেও সেই রকম চিরন্তন, একমাত্রিক এবং সম্পত্তি ভাবি। আর তাই সেই সম্পত্তি হঠাৎ আমার থেকে অন্য কারও কাছে গেলে প্রায় চুরিই ভেবে ফেলি তাকে। ভুলে যাই, অপর মানুষটি কোনও দ্রব্য নয়, তার মন-মাথা-শরীর সচল ও স্ব-সিদ্ধান্তে চলে। ভুলে যায় বলেই এত হিংসার বাতাবরণ তৈরি হয়।

এ কথা ঠিক যে, সম্পর্ক চিরন্তন হলে হয়তো আরাম হত। কিন্তু সে সম্পর্ক একমাত্র সম্ভব নিজের সঙ্গে। অথচ নিজের সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কোনও শ্রমই দিই না আমরা। অন্য মানুষ, অন্য সম্পর্ক, অন্য সব কিছুতে এত মন দিয়ে ফেলি যে, আমার ভিতর বসবাস করছে যে মানুষ, যে চেতনা, তার সঙ্গে দূরত্ব হয়ে যায় আমাদের। সময় এসেছে নিজের প্রেমে নিজে পড়ার, নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক গড়ে তোলার। যাতে অন্য কেউ হাত ছেড়ে দিলেও আমি যেন আমার হাত না ছেড়ে দিই। যদি সময় বিরূপ হয়, যদি কালকের অনেক প্রতিপত্তি আজ হঠাৎ কমে যায়, যদি আগামী কালের কোনও অনিশ্চয়তা বাসা বাঁধে, সে সম্পর্কের হোক, অর্থের হোক কিংবা কাজের হোক, আমি যেন আমার হাত ধরে থাকি আর বার বার নিজেকে বোঝাই, ‘এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা আমায় ছাড়া’।

পৃথিবীতে মহামারী আসবে কি না, আমার আজ কাজ আছে, কাল থাকবে কি না, আমার সম্পর্ক চিরন্তন হবে কি না, আমার প্রিয়জনেরা আমার সঙ্গে থাকবে কি না, কোনও আচমকা শোক এসে আমাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করবে কি না— এর কোনও কিছুই আমার হাতে নেই। আমার হাতে কেবল ‘আমি’ পড়ে আছি, সেই যে সুকুমার রায়ের ‘হাতে রইল পেন্সিল?’ ওই ‘পেন্সিল’টা আসলে ‘আমি’। সেই ‘আমি’কে কিছুতেই হারালে চলবে না। তা হলে আর আগামীর হিসেব করার পেন্সিলটাই থাকবে না যে। উপরের ‘আমিত্ব’কে ছেড়ে অন্তরের ‘আমি’র সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব তৈরি করতে বসতে হবে আমাদের। সময় দিতে হবে। আর নিজের হাত ধরতে পারলে দেখা যাবে হয়তো আমরা আরও দু’-এক জনের হাত ধরতে পারছি আর আটকাতে পারছি পল্লবী, বিদিশা, মঞ্জুষাদের আত্মহত্যা বা সুতপার খুন।

আর হ্যাঁ, কষ্ট হলে যেন কেঁদে নিতে পারি। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের অংশ বলে কাজল ধেবড়ে যাওয়ার ভয়ে যেন কান্না চেপে না রাখি। সারা দিন খুশি থাকতে হবে, নিখুঁত সেজে থাকতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি আমাদের। একটা জীবন, বেড়াতে আসার মতো করে উপভোগ করতে হবে। কারণ, সেই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলে গিয়েছিলেন, ‘‘এসেছি দৈব পিকনিকে’’, সে কথা ভুললে চলবে কেন!

(লেখক কবি ও চিত্রনাট্যকার। মতামত ব্যক্তিগত)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement