পালস অক্সিমিটারে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ বা তার উপরে থাকলে চিন্তা নেই। ফাইল ছবি
শহরের নতুন ট্রেন্ড পালস অক্সিমিটার। অনেকটা জামা-কাপড় শুকাতে দেওয়ার ক্লিপের মতো দেখতে। একপ্রান্ত টিপে ধরে হাঁ-মুখে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে সুইচ অন করলে শরীরে অক্সিজেন কত আছে তা জানা যায়। সাধারণত হাসপাতালে, বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে এর ব্যবহার হয়। গুরুতর অসুস্থ রোগীর শরীরে অক্সিজেন কমছে কি না তা জানতে দিনে ৩-৪ বার বা প্রয়োজন মতো পরীক্ষা করে দেখেন সিস্টাররা। জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় একটু বড় একটা মেশিন। মেশিন লাগাতার অক্সিজেন মাপতে থাকে আর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন চিকিৎসক।
সেই মেশিনের ছোট ভারসন, পালস অক্সিমিটার প্রোব এখন ঘরে ঘরে। কোভিড রোগীরা তো বটেই, যাঁদের এখনও রোগ হয়নি, তাঁরাও দিনে ৩-৪ বার মাপছেন, যাতে হঠাৎ যদি শ্বাসকষ্ট হয় বা শ্বাসকষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও যদি শরীরে অক্সিজেন কমে যায়, যাকে বলে হ্যাপি হাইপক্সিয়া, চট করে ধরে ফেলতে পারেন।
"ধরে তো ফেললেন, তার পর?" প্রশ্ন তুললেন চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। "এর চিকিৎসাও কি ঘরে করবেন? না হাসপাতালে যাবেন? হাসপাতালের যা অবস্থা, আগে থেকে চেষ্টা করেও মানুষ বেড জোগাড় করতে পারছেন না, সেখানে শ্বাসকষ্টের রোগীকে নিয়ে পথে পথে ঘুরবেন? সে রোগী যদি গাড়িতেই মারা যান? হচ্ছে তো এমন, খবরে দেখছেন না!"
আরও পড়ুন: গ্যাস-অম্বলের সমস্যায় মুঠো মুঠো ওষুধ? বাড়ছে করোনার ঝুঁকি
পালস অক্সিমিটার কিনবে্ন না?
"কিনে লাভ কী? ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অক্সিজেন মাপারই দরকার নেই", জানালেন অমিতাভ নন্দী।
আচমকা রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কম দেখলে দুর্বল মনের মানুষের প্যানিক অ্যাটাক হতেই পারে। ফাইল ছবি
"রোগ এত হালকাভাবে থাকে যে, এমনিই সারে। সেখানে পালস অক্সিমিটার কেনা মানে পয়সার অপচয়। উপরি পাওনা টেনশন। ওই যে শুনে নিয়েছেন, শ্বাসকষ্ট না হলেও তলে তলে অক্সিজেন কমতে পারে, আর সেটা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলে ব্যবস্থা না নিলে রোগী আচমকা মারা যেতে পারেন, এটা একটা প্রবল টেনশনের ব্যাপার। ফলে দিনে ৩-৪ বার বা যখনই অক্সিজেন মাপতে যাবেন, একটু হলেও হার্টবিট বাড়বে। দুর্বল মনের মানুষ হলে শ্বাসকষ্ট না হলেও মনে হচ্ছে বুঝি। প্যানিক অ্যাটাকের নাম শোনেননি? পুরোদস্তুর প্যানিক অ্যাটাক হলে তো হয়েই গেল! মানসিক কারণে শ্বাসকষ্ট হল আর আপনি এ হাসপাতাল সে হাসপাতাল ঘুরে বেড়ালেন। কোভিড না হলেও, এ রকম পরিস্থিতিতে হতে কতক্ষণ?"
আরও পড়ুন: কখন প্রয়োজন ভেন্টিলেটর? কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার এটির?
পালস অক্সিমিটার ও প্যানিক অ্যাটাক
অ-ডাক্তার হয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপতে বসলে, দুর্বল মনের মানুষের প্যানিক অ্যাটাক হতেই পারে। হিসেব অনুযায়ী রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ বা তার উপরে থাকলে চিন্তা নেই। কিন্তু পালস অক্সিমিটার যে ১০০ শতাংশ অভ্রান্ত, এমন তো নয়। সে যা রিডিং দেয়, বাস্তবে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা তার চেয়ে ২ কম বা বেশি হতে পারে। মানে ৯৭ রিডিং হলে স্যাচুরেশন ৯৫ থেকে ৯৯-এর মধ্যে আছে। সুতরাং কেউ যদি বলে, ৯৪-এর কম হলেই কেস খারাপ আর রিডিং যদি আসে ৯৩, আপনার কেস খারাপ নাও হতে পারে। কিন্তু আপনি তো সেটা জানেন না। কাজেই আপনার টেনশন কে আটকাবে?
কেন এমন হয়? হতেই পারে। যন্ত্র বলে কথা। তার উপর সে মাপে স্রেফ রং। রক্তে যখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসে, তার রঙের পরিবর্তন হয়। রক্তে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন থাকলে তার রং হয় টকটকে লাল। অক্সিজেন কমতে থাকলে এই লালিমা বদলে যায়। পাল্স অক্সিমিটার মাপে ওই লালিমা। এবার, আপনি যদি আঙুলে লাল রং লাগিয়ে থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই রিডিং বেশি আসবে। কারণ সে তো আর জানে না, এটা রক্তের রং না নেল পালিশের রং। তাকে রং মাপতে বলা হয়েছে, সে রং মেপেছে। ব্যাস। তাতে আপনার বিপদ বাড়তে পারে।
অর্থাৎ, স্রেফ রিডিং মেপে আপনি ভাল আছেন না মন্দ, তা বোঝা আপনার কম্মো নয়। লাভের লাভ, কম রিডিং এলে ও দুর্বল মনের মানুষ হলে প্যানিক অ্যাটাকের আশঙ্কা। কাজেই এই সব মাপামাপির ব্যাপার চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজে নির্ভাবনায় থাকাই সবচেয়ে ভাল পন্থা।
১০-২০ শতাংশের সত্যি বিপদ, তাঁরা কী করবেন?
"সেখানেই বা আপনি নিজে অক্সিজেন মেপে কী করবেন? কমে গেলে তো সেই হাসপাতালেই যেতে হবে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৫-এর নীচে নেমে যাওয়ার পর যদি হাসপাতালের দোরে দোরে ঘুরতে হয়, ব্যাপারটা যথেষ্ট বিপজ্জনক। কারণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মানে রোগ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় পার করে তৃতীয় পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা এমনিই মুখের কথা নয়। তার উপর যদি আবার চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়!" জানালেন অমিতাভ নন্দী।
এখানে একটু দ্বিমত পোষণ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী। তাঁর মতে, “স্বাভাবিক অবস্থায় ঘরে বসে নিজেই নিজের অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপাটা যদিও কোনও কাজের কথা নয়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন মহামারি নিয়ন্ত্রণ বলতে গেলে আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে, প্রথম পর্যায়ে রোগ ধরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যখন আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র, এমনকি, দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগ ধরার মতোও পরিস্থিতি নেই, পালস অক্সিমিটার তখন কিছুটা হলেও জীবনদায়ী হতে পারে। এখন আমরা যে পর্যায়ে রোগী পাচ্ছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর কিছু করার থাকছে না। তার অন্তত ঘণ্টা ছয়েক আগেও যদি পাওয়া যায়, চেষ্টা করলে হয়তো প্রাণ বাঁচলেও বাঁচতে পারে। তাই বয়স্ক ও কো-মর্বিডিটি থাকলে ঘরে পাল্স অক্সিমিটার রাখলে কোনও ক্ষতি নেই, বরং ভাল।”
তা হলে কী করবে মানুষ?
“এখানে ব্যক্তি মানুষের যেমন ভূমিকা আছে, ভূমিকা আছে সরকারেরও”, জানালেন অমিতাভবাবু। “যে কোনও মূল্যে রোগ ধরতে হবে প্রথম পর্যায়ে। অর্থাৎ যখন উপসর্গ হয়নি বা খুব মৃদু উপসর্গ হয়েছে, যাতে তখনই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কাকে হাসপাতালে কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে আর কে বাড়িতে বা কোয়রান্টিন সেন্টারে একটু শুয়ে থেকে বা দু-চারটে ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়ে যাবেন। এঁদের মধ্যেও দু-চারজনের পরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে প্রথম থেকে কড়া নজরদারিতে থাকলে সেই সংখ্যা অনেক কমে যায়। কমে রোগের জটিলতাও। মহামারিকে বশে আনার এটাই একমাত্র রাস্তা। ভেবে দেখুন, প্রথম পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে মানুষকে আলাদা করে দেওয়া হয় বলে একদিকে যেমন রোগ কম ছড়ায়, অন্য দিকে কড়া নজরদারি চলে বলে রোগ দ্বিতীয় পর্যায়ে (যখন জ্বর-কাশি বাড়ছে বা হালকা চাপ ধরছে বুকে) বা তৃতীয় পর্যায়ে (যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে) যেতে পারে না খুব একটা। ফলে রোগীর টাকা বাঁচে। হাসপাতালে বেডের আকাল হয় না।”
"সাধারণ মানুষের কাছে আমার অনুরোধ", বললেন সুবর্ণবাবু, "একটু জ্বর এসেছে মানে বৃষ্টিতে ভিজেছি, একটু কাশি হয়েছে মানে ঠান্ডা খেয়েছি, এসব অছিলায় নিজেকে না ভুলিয়ে, ডাক্তার দেখান। উপসর্গ কমে গেলেও দেখান।
তিনি বললেন, পরীক্ষা করিয়ে নিন। মনে রাখবেন, মহামারির সময় এই ধরনের যে কোনও উপসর্গ হলে আগে কোভিডের কথাই ভাবতে হবে। এটাই নিয়ম। প্রতিবেশী কী ভাববে, তা নিয়ে ভাবতে বসবেন না। কারণ রোগ যে হারে বাড়ছে, কালক্রমে তা ঘরে ঘরে ঢুকে যাবে। তখন কেউ আর কিছু ভাবার অবকাশ পাবেন না। আর এই ভয়ে রোগ নিয়ে বসে থাকলে, বাড়িতে সবার ছড়াবে। ছড়াবে আশপাশে। কারও কারও বাড়াবাড়ি হবে। মরতে হবে ধনে-প্রাণে।"
বয়স্ক মানুষ হলে ও কো-মর্বিডিটি থাকলে ঘরে পাল্স অক্সিমিটার রাখা যেতে পারে, মত একাংশের। ফাইল ছবি
অমিতাভ নন্দী বলেন, "সরকারের কাছে আমার অনুরোধ পুলিশ পাঠিয়ে পালস অক্সিমিটারের ট্রেনিং না দিয়ে, সবাইকে ধরে ধরে পরীক্ষা করান। সবার হাতে পালস অক্সিমিটার ধরিয়ে দেওয়ার অর্থ হল, সরকার মেনে নিচ্ছেন, মহামারি নিয়ন্ত্রণের যে প্রাথমিক শর্ত, রোগকে প্রথম পর্যায়ে আটকে ফেলা, তা করতে তাঁরা অপারগ। তা ছাড়া, সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তো এমন নয় যে সব তৃতীয় পর্যায়ের রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারবে! বেসরকারি হাসপাতালের খরচ সামলানো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। যাঁদের হাতে টাকা আছে, তাঁরাও বেড পাচ্ছেন না। কাজেই পাল্স অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন মেপে তার পর হাসপাতাল খুঁজতে বেরোনো ভুল পন্থা। মহামারি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সঠিক পথে এগোন।"
আরও পড়ুন: করোনা কতটা ক্ষতি করছে স্নায়ুতন্ত্র-মস্তিষ্কে, কী বলছেন চিকিৎসকরা
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)