মাস্কের ব্যবহার এখন অপরিহার্য। ছবি:পিটিআই
আমরা মাস্ককে চিনেছি করোনার কারণে, কিন্তু মাস্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৮৯৭ সালে ফরাসি শল্য চিকিৎসক পল বার্গার প্রথম মাস্ক ব্যবহার করেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল কথা বলার সময়ও ড্রপলেটের মাধ্যমে মুখ থেকে যে জীবাণু বের হয়, অপারেশনের ঘা বিষিয়ে দিতে তা একাই একশো।
প্রথম দিকে সার্জিকাল গজ নাকে-মুখে জড়িয়ে কাজ হত। পরের বছর বিজ্ঞানী হুবনার জানান, যত পুরু করে গজ জড়ানো হবে, তত ভাল। এবং এক বার ব্যবহার করেই তা ফেলে দিতে হবে। এর পর ধীরে ধীরে মাস্কের প্রয়োজনীয়তা ও ধরন বদলাতে থাকে।
মাস্কের বিবর্তন
• ১৮৯৯ সালে যক্ষ্মা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারের প্রসঙ্গ আসে। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী হ্যামিলটন জানান, স্ট্রোপ্টোকক্কাস জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে অদৃশ্য থুতু তথা ড্রপলেটের মাধ্যমে। তিনি বললেন, স্কারলেট ফিভারও ছড়ায় ড্রপলেট দিয়ে। কাজেই নার্সদের মাস্ক পরতে হবে।
• ১৯১৮ সালে চিকিৎসক ওয়েভার জানান, ডিপথেরিয়া ঠেকাতে মাস্কের বিকল্প নেই। সেই মাস্ক ভিজে গেলে পাল্টাতে হবে। এবং হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে হাত দেওয়া যাবে না।
• স্প্যানিশ ফ্লুয়ের বছরে মাস্ক হয়ে গেল সর্বজনীন। কারণ তত দিনে ফ্লু ঠেকাতে তার অপরিহার্যতার কথা জেনে গিয়েছেন সবাই।
• ২০১৩ সালে গবেষকরা প্রমাণ করলেন, ফ্লুয়ের রোগী এবং তাঁর ধারে কাছে যাঁরা থাকেন তাঁরা সবাই যদি মাস্ক পরেন রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা ৬০-৮০ শতাংশ কমে যায়। জানা গেল, জ্বর-হাঁচি-কাশি হলে বা স্রেফ হাঁচি-সর্দি হলেও রোগীর চারপাশে এমনিই ভাইরাসের বাতাবরণ থাকে, তা কাশি হোক বা না হোক।
আরও পড়ুন: আসল এন৯৫ চিনবেন কী করে? সংশয় হলে কী করবেন?
অতএব
হাঁচি-কাশি বা কথা বলার মাধ্যমে ছড়ায় যত রোগ, তা সে টিবি হোক কি সাধারণ হাঁচি-কাশি-সর্দি, করোনা হোক কি সাধারণ ফ্লু, সবার উত্তর লেখা আছে মাস্কের মধ্যেই। মাস্ক ঠেকায় পরিবেশ দূষণের ক্ষতি। পোলেন অ্যালার্জি, ডাস্ট অ্যালার্জি, পরোক্ষ ধূমপান জনিত ক্ষতির আশঙ্কা। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর তরফে জানানো হয়েছে, ঘরে বানানো সাধারণ থ্রি লেয়ার মাস্ক পরলেই বিপদের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। এগুলি ভাইরাস আটকাতে পারে ৫০ শতাংশ।
বাজারচলতি যে কোনও মাস্ক ব্যবহারের আগে সতর্ক থাকুন। ছবি: এএফপি
কখন মাস্কের প্রয়োজন, কখন নয়
কোভিড জাঁকিয়ে বসার পর ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশনের তরফ থেকে জানানো হল, ঘন ঘন হাত ধোওয়া ও ৬ ফুটের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি ঘরের বাইরে পা দিলে মাস্কও পরতে হবে সবাইকে। তাতে কম করে ৭০-৮০ শতাংশ সুরক্ষা পাবেন। আর আশপাশের সবাই যদি মাস্ক পরেন ও ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখেন, পাল্লা দিয়ে বাড়বে সুরক্ষার মাত্রা।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে ভিটামিন ডি-র অভাব হতে পারে বিপজ্জনক, কেন জানেন?
কোন মাস্ক, কতটা সুরক্ষা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না, সেখানে সাধারণ কাপড়ের মাস্ক নয়, পরতে হবে ত্রিস্তরীয় মাস্ক, বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৬০ এর বেশি বা কোনও জটিল অসুখ-বিসুখ তথা কো-মর্বিডিটি আছে। মাস্কের বাইরের স্তর তৈরি হবে পলিয়েস্টার জাতীয় উপাদানে, মাঝের স্তরে থাকবে বুননহীন পলিপ্রপিলিন জাতীয় উপাদান এবং ভিতরের স্তরে সুতি। এ রকম মাস্ক পরলে ৯০ শতাংশ সুরক্ষা পাবেন। ত্রিস্তরীয় ডিসপোজেবল সার্জিকাল মাস্কেও এতটাই সুরক্ষা। তবে রোজ ফেলতে হবে। সিঙ্গল লেয়ার সার্জিকাল মাস্ক দুটো করে পরলে প্রায় ৯০ শতাংশ সুরক্ষা হয়। তবে কাপড়ের মাস্কের সুবিধা হল, বাড়ি এসে ভাল করে সাবানে কেচে চড়া রোদে শুকিয়ে নিলেই আবার চার দিন পর সেটা ব্যবহার করা যায়।
আরও পড়ুন: করোনার আবহে বিপদ বাড়াতে পারে সোরিয়াসিস, কী করবেন কী করবেন না
সাধারণ মানুষের এন-৯৫ মাস্ক পরার দরকার নেই। কারণ যদি সঠিক পদ্ধতিতে পরেন, অর্থাৎ টেনে ব্যান্ড বেঁধে এবং নাকের ব্রিজ চেপে, এন-৯৫ পরে বেশিক্ষণ থাকা খুব কঠিন। টাইট করে পরতে হয় বলে ১০-১৫ মিনিটে দম আটকে আসে। পরে বাইরে বের হলে কানে টান পড়ে, ব্যথা করে। নাক চুলকোয়। চশমা ঝাপসা হয়ে আসে। ফলে বার বার হাত লাগিয়ে ঠিক করতে হয়। যেটা আরও বিপজ্জনক। দামি মাস্ক পরেছেন বলে হয়তো আপনি নিজেকে এতটাই সুরক্ষিত ভেবে বসলেন যে আশপাশের মানুষের হাঁচি-কাশিকে গুরুত্ব দিলেন না বা ধরে নিলেন, হাত ধোওয়ার দরকার নেই। সেখান থেকে বিপদ আসতে পারে। তবে রোগীর সেবা বা চিকিৎসা করলে এই মাস্ক পরা জরুরি। মোটামুটি ৯০-৯৫ শতাংশ সুরক্ষা এতে পাওয়া যায়।
কখন পরবেন, কখন নয়
• রাস্তায় বের হলে অবশ্যই পরবেন। সে বাজারে যান, কি অফিসে। ঘরে লোকজন এলে পরবেন।
• ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে বের হলে পরার দরকার নেই। তবে সঙ্গে রাখবেন। কেউ কথা বলতে এলে পরে নেবেন।
• অফিসে আলাদা ঘর থাকলে সব সময় পরার দরকার নেই। তবে কেউ ঢুকলে পরতে হবে।
• মাস্ক পরে ব্যায়াম করবেন না। শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি, হাঁপানি বা আইএলডির মতো ক্রনিক ফুসফুসের অসুখ থাকলে বড় সমস্যা হতে পারে।
• যে সমস্ত শিশুর হাঁপানি বা জন্মগত হার্টের অসুখ আছে তাদের মাস্ক পরানোর আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
• এন-৯৫ মাস্ক পরে গাড়ি না চালানোই ভাল। অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গেলেও চালাতে অসুবিধা হতে পারে। কাজেই ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল বা মোটর সাইকেল চালালে মাস্ক পরার দরকার নেই। অবশ্য এখন যেমন বলা হচ্ছে, করোনা বাতাসবাহিত হতে পারে, তেমন যদি সত্যিই হয়, বাইক বা সাইকেল চালালেও মাস্ক পরতে হবে।
মাস্কের সঙ্গে ফেস শিল্ডেরও ব্যবহার বেড়েছে। ছবি: এএফপি
মাস্ক পরার আগে-পরে
• মাস্ক পরার আগে সাবান-জলে হাত ভাল করে ধুয়ে মুছে নিন।
• এমনভাবে চেপে পরুন যে, নাক ও মুখ আঁটসাঁটভাবে মাস্কের মধ্যে থাকে।
• মাস্কের উল্টো পিঠ ব্যবহার করা যাবে না।
• অন্যের ব্যবহৃত মাস্ক পরা যাবে না।
• মাস্কের সামনে হাত দেবেন না। কথা বলার সময় নামিয়ে দেবেন না। কোনও কারণে হাত দিতে গেলে আগে হাত ধুয়ে নেবেন। ধুতে হবে হাত দেওয়ার পরও।
• ডিসপোজেবল মাস্ক এক বারের বেশি ব্যবহার করবেন না।
• মাস্ক খোলার সময় প্রথমে পিছনের ফিতে খুলবেন। নাক-মুখের অংশে হাত দেবেন না। ডিজপোজেবল হলে খুলে ঢাকা দেওয়া বিনে ফেলে হাত ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)