লন্ডনের বাসিন্দা চিকিৎসক রিমোনা সেনগুপ্ত। নিজস্ব চিত্র
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে নাজেহাল ব্রিটেন। ডেল্টা প্রজাতির আশঙ্কায় লকডাউন তুলে দেওয়ার তারিখ পিছিয়ে গিয়েছে। কলকাতার মেয়ে রিমোনা সেনগুপ্ত লন্ডনের চিকিৎসক। পূর্ব লন্ডনে প্রত্যেক দিন করোনা-রোগীদের চিকিৎসা করার পাশাপাশি ‘লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডেসিন’-এ পড়াশোনা করছেন সংক্রামক রোগ নিয়ে। ভারতে আসন্ন তৃতীয় ঢেউ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন তিনি। কী ভাবে এই বিপদের জন্য আরও ভাল করে প্রস্তুত হওয়া সম্ভব, জানালেন ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে।
লন্ডনের অবস্থা এখন ঠিক কী রকম?
তৃতীয় ঢেউয়ে বেশ নাজেহাল গোটা শহর। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংক্রমণের হার বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ডেল্টা প্রজাতির বাড়বাড়ন্তে সেই সংখ্যাটা হঠাৎই জুন মাসের প্রথমে অনেকটা বেড়ে গেল। এখন আবার ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু পরের সপ্তাহেই কী হবে, কেউ জানেন না।
ওখানে কি মোটামুটি সকলের টিকাকরণ হয়ে গিয়েছে?
অনেকেরই হয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষের শুধু একটা ডোজ হয়েছে। আসলে একদল মানুষ আছেন, যাঁরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ে টিকা নিতে চাইছেন না। তাঁদের ৩-৪ বার বলার পর হয়তো নিচ্ছেন। আবার অনেকে ভাবছেন, বাকিরা নিক, দেখি কী দাঁড়ায়, তার পরে আমরা নেব। বুঝতে পারছেন না, অতিমারির মধ্যে এত অপেক্ষা করার মতো পরিস্থিতিতে আমরা নেই। তার উপর আর এক দল তো রয়েছেই! যাঁদের মতে, ‘করোনা-টরোনা কিস্যু না, এতে আমার কিছু হবে না।’ এই সব কারণে ব্রিটেনে সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। অনেক কমবয়সিদের মধ্যে দেখছি, হয়তো হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না, কিন্তু লং কোভিডে ভুগছেন তাঁরা। কেউ ৩ মাস, কেউ ৬ মাস! ক্লান্তি, গায়ে ব্যথা— নানা ধরনের নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে এই লং কোভিডে।
ভারতেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কমবয়েসিরা খুব ভুগছেন।
অত্যন্ত একটা রাজনৈতিক কথা বলা হয়ে যাবে, কিন্তু যে দেশের জনসংখ্যা এত বেশি, সেখানে নিজেদের মানুষকে প্রতিষেধক না দিয়ে আগেই কী করে বিদেশে রফতানির কথা ভাবা হল, তা বোঝা মুশকিল। তবে টিকাকরণের হার প্রত্যেকটা রাজ্যে এক রকম হয়নি। খুব কম সংখ্যার মানুষ টিকা পেয়েছেন। শুনেছিলাম এক একটা হাসপাতালে দিনে নাকি ১০০-২০০ জন করে টিকা দেওয়া হচ্ছে। লন্ডনেই এক একটা জায়াগায় রোজ ১৫০০টা করে টিকা দেওয়া হয়েছে। তা হলে ভারতের মতো জনসংখ্যায় ১০০ জন কতটা কম, ভেবে দেখুন।
একসঙ্গে অতজনকে টিকা দেওয়ার উপায় কী?
লন্ডনে টিকাকরণের নিয়ম অনেকটাই আলাদা। একেকটা কেন্দ্রে যাঁরা টিকা দিচ্ছেন, সেই স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ২-৩ জনের বদলে অন্তত ৬-৭ জন। তাই একেক ঘণ্টায় অনেক বেশি মানুষ টিকা পাচ্ছেন। তবে ভারতে এই ধরনের কেন্দ্র করা মুশকিল। মানুষ টিকা নিতে গিয়ে এমন ভিড় করবেন যে, সেখান থেকেই সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে। তাই ভ্যান বা বাসে করে মোবাইল টিকাকরণের কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে পারলে সবচেয়ে সুবিধা। অনেক তাড়াতাড়ি বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে।
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
ব্রিটেনে টিকাকরণের ব্যবস্থা আরও উন্নত। লকডাউনও করা হয়েছে। কিন্তু তা-ও তো তৃতীয় ঢেউ আটকানো গেল না?
লকডাউনের কিছু নিয়ম রয়েছে। সংক্রমণের হার কমলেই শুধু হয় না। একটা জায়গায় কত জন টিকা পেলেন, সেটা দেখে লকডাউন শিথিল করা উচিত। নয়তো কয়েকটা সমস্যা থেকেই যাবে। এক, যে ক’জন প্রতিষেধক পেয়েছেন, তাঁদের তুলনায় আরও অনেকে হয়তো পাননি। কিন্তু দু’দলই মেলামেশা করছে। এতে যাঁরা পাননি, তাঁদের সংক্রমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। দুই, অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গহীন মানুষই বেশি সংখ্যায় থাকেন। বা হয়তো মৃদু উপসর্গ রয়েছে, পরীক্ষা না করিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুই ক্ষেত্রেই তাঁরা আরও অনেক মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলছেন। তিন, লক়ডাউন খুললেই মানুষ ভাবেন ‘করোনা চলে গিয়েছে।’ তাতেই আরও বিপদ হয়। মানুষ এন্তার ঘোরাফেরা, বাজারহাট, বিয়ে-শাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আপনার মতে লকডাউনই তা হলে উপায়?
তা নয়। একটা নতুন তরঙ্গ আটকানোর উপায় তেমন নেই। কোনও ভাইরাস যখন রূপ পরিবর্তন করে, এক ভাবে না, অনেক ভাবে করে। ভারতে অনেকগুলি প্রজাতি তৈরি হয়েছিল। সেগুলি মিলিয়ে গিয়েছে। এখন বেঁচে গিয়েছে ডেল্টা প্রজাতি। কারণ এটাই সবচেয়ে মারাত্মক। ব্রিটেনের কেন্ট প্রজাতির তুলনায় অন্তত ৬০ শতাংশ বেশি সংক্রামক ডেল্টা। এই মুহূর্তে ভারতে হয়তো ডেল্টা প্রজাতির সংক্রমণ কমে গিয়েছে। কিন্তু বাকি পৃথিবীতে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলি ফের নতুন ভাবে মিউটেট করবে। ফলে নতুন ঢেউ আটকানোর উপায় নেই।
তা হলে কী করণীয়?
মানুষকে টিকাকরণের বিষয়ে আরও সচেতন করতে হবে। বোঝাতে হবে জন্মানোর পর যেমন বিসিজি, এমআরআর, পোলিয়ো বা হেপাটাইটিসের টিকা নিতে হয়, এটাও তেমনই। দেশের প্রত্যেকটি মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এক জায়গায় নথিভুক্ত করা খুব প্রয়োজন। এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে অনলাইনে যেখান থেকে চিকিৎসকেরা সহজেই সব তথ্য পেয়ে যান। ধরুন একজনের ডায়াবিটিস রয়েছে। করোনা নিয়ে যখন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, সেই তথ্য যেন তাঁর চিকিৎসক সহজেই পেয়ে যান। যাতে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে অহেতুক দেরি না হয় যায়। মানুষকে বোঝাতে হবে, শুধু নিজেকে সুরক্ষিত রাখলেই হবে না। অন্যদেরও সুরক্ষিত করতে হবে। কী করে মাস্ক পরা উচিত, বা খুলে ফেলে দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি কী, এগুলো নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তার পরে ‘সোশ্যাল বাব্ল’-এর ধারণা সকলের কাছে পরিষ্কার নয়। একটা বিল্ডিংয়ে নিজস্ব বুদবুদ তৈরি করতে পারেন। নির্ভয় মেলামেশা করতে পারেন। কিন্তু তখনই, যখন সেই বিল্ডিংয়ের মানুষ বাইরে যাচ্ছেন না, আবার বাইরে থেকে কেউ সেখানে আসছেনও না। একটা বুদবুদের মানুষ অন্য বুদবুদে ঘোরাফেরা করতে পারেন না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গেলে এখন কারও বাড়ি গিয়েও পার্টি করা যাবে না। এই বিষয়গুলি বুঝিয়ে বলতে হবে। এবং সরকারের উচিত সব আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রচার করা, শুধু হিন্দি বা ইংরেজিতে নয়।
একটানা লকডাউনে অনেক মানুষ রোজগারের পথ হারিয়েছেন। তাই সকলেই হাঁপিয়ে উঠেছেন।
এর জন্য সরকারের পক্ষে থেকে যেমন উপার্যনের পথ বাড়ানোর প্রকল্প নিতে হবে, তেমনই বুঝতে হবে অতিমারি শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যা নয়, একটি সামাজিক ব্যধিও। মানুষ রোজগার হারিয়ে, বাড়ি বসে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছেন। তাই তাঁদের সাহায্যের জন্য নানা রকম হেল্পলাইন নম্বর খুলতে হবে। যেখানে বিভিন্ন ভাষায় কাউন্সিলিং করা হবে। তৃতীয় ঢেউ আসার আগেই এই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলা প্রয়োজন।