ছবি: সংগৃহীত।
মাঝে রব উঠল বাতাসে ভেসে বেড়ায় করোনা৷ গণহারে মাস্ক পরা শুরু হল৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিজ্ঞানীরা জানালেন, না, ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে তথ্যের৷ নোভেল করোনা বাতাসে ভেসে বেড়ায় না৷
গতকাল প্রতিষ্ঠিত এক ডাক্তারবাবুর ফোন, “আমরা কিন্তু কিচ্ছু জানি না৷ যদি সে বাতাস থেকে ছড়ায়! বাড়িতে বসে থাকো স্রেফ৷ রিস্ক নিও না৷”
এর পরেই হাতে এল ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক লেখা, ‘করোনাভাইরাস সম্বন্ধে আমরা কী জানি এবং কী কী জানি না৷’ আসুন, তা হলে জেনে নেওয়া যাক৷
ভাইরাস
ভাইরাস আদতে কী?
সে খুবই ছোট্ট একটি বস্তু। বস্তুই বলছি, কারণ তার প্রাণ আছে কি নেই তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে৷ কত ছোট সে, ধারণার অতীত৷ মাথার একটা চুলের কথা ভাবুন, তার হাজার ভাগের এক ভাগ৷ তারই অন্দরে রয়েছে তার চরিত্র নির্ধারক কিছু জেনেটিক কোড, তাকে ঘিরে প্রোটিন ও ফ্যাটের আস্তরণ৷ সবে মিলে বড়জোর ১৫-৩০০ ন্যানোমিটার তার মাপ৷ এমনকি, একটা ব্যাক্টেরিয়ার মাপও তার চেয়ে বেশি৷
এ বার আবার সেই পুরনো প্রশ্ন, তার কি প্রাণ আছে? বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নে রীতিমতো দ্বিধাবিভক্ত৷ প্রাণই যদি থাকবে, বংশবৃদ্ধির জন্য সে কেন অন্য কারও জীবিত কোষের উপর নির্ভর করে! কেন তাদের নিজের প্রতিলিপি, বা বলা যায় সন্তানসন্ততি বানানোর কারখানায় পরিণত করে! উত্তর জানা নেই এখনও৷ তবে এই কাণ্ড-কারখানার ফলেই যে ভাইরাস সংক্রমণ সারানো রীতিমতো কঠিন, জীবিত কোষের হানি না ঘটিয়ে যে তার রাজ্যপাট ধ্বংস করা যায় না, তা এক ধ্রব সত্য৷
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসের ত্রাসে কাঁপছে এই অন্য করোনাও
করোনাভাইরাস কী?
বিশ্ব জুড়ে কোভিড-১৯ রোগের যে অতিমারি লেগে গিয়েছে তার মূলে আছে সে৷ পোশাকি নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস ২, বা সংক্ষেপে সার্স-কোভ-২৷
করোনা নাম কেন? নামটি এসেছে লাটিন ভাষা থেকে৷ যার অর্থ মুকুট৷ ভাইরাসের বাইরের অংশে রয়েছে এ রকম মুকুটের মতো প্রচুর কাঁটা, যা বিঁধিয়ে মানব-কোষে পা রাখে ১২ ন্যানোমিটার মাপের ৩০টি জিনসমৃদ্ধ নোভেল করোনাভাইরাস৷ তার পর অবলীলায় নাকানিচোবানি খাওয়ায় ২০,০০০ জিনসমৃদ্ধ মানুষকে৷
আরও পড়ুন: করোনা-হানা থেকে সন্তানকে বাঁচাতে মেনে চলুন এ সব
অতিমারি
কী অবস্থা এখন?
অবস্থা খুবই করুণ৷ সারা বিশ্বের অবস্থা ঠিক কী জানতে জন হপকিন্স করোনাভাইরাস সেন্টারের ওয়েবসাইট বা ভারত সরকারের ওয়েবসাইটে চোখ রাখুন৷
এর অগ্রগতি রুখতে সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
চেষ্টা হচ্ছে প্রচুর৷ সাধারণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যেমন হাত ধোওয়া, স্যোশাল ডিসট্যান্সিং, অন্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দিনরাত ঘরে থাকা, বিদেশি কারও সংস্পর্শে এলে পুরোপুরি আইসোলেশনে চলে যাওয়া, ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কারও রোগ হলে তাঁর সংস্পর্শে যত জন আছেন, কাছের অথবা দূরের, সবাইকে চিহ্নিত করে প্রথমে কোয়রান্টিন, তার পর প্রয়োজনে পরীক্ষা করে দেখা তাঁর মধ্যে সংক্রমণ হয়েছে কি না ইত্যাদি চলছে হাতেকলমে৷ লাগাতার প্রচার করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ তাতে তার গতি রুদ্ধ না হওয়ায় রুজু হল লকডাউন৷ তবে নতুন এই ভাইরাসকে পরাস্ত করার সব প্রচেষ্টাই যে সমান ভাবে ফলপ্রসূ হবে এবং এই রাস্তায় চলেই একে পুরোপুরি দূর করা যাবে, এমন কথা ১০০ শতাংশ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না৷ কারণ, এই পথে চলে নতুন কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা চিনে নাটকীয় ভাবে কমে গেলেও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করলেই যে ভাইরাস আবার নতুন করে দেখা দেবে না তা বলা যায় না৷ তবে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে হয়তো আরও কিছু পন্থা বেরবে যার সাহায্যে কাজটা আরও সহজ হবে৷
অতিমারি থাকবে কত দিন?
ইম্পিরিয়াল কলেজের মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল সেন্টার ফর গ্লোবাল ইনফেকশাস ডিজিজের তরফে বিশিষ্ট সব এপিডেমিওলজিস্টরা মিলেমিশে যে করোনাভাইরাস এপিডেমিক মোডালিটি রিপোর্ট বানিয়েছেন, তার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এই অতিমারি এখনই শেষ হয়ে যাবে না৷ চলবে কমপক্ষে আরও কয়েক মাস৷ কারণ এই ভাইরাস কী ভাবে ছড়ায় তা নিয়ে সব তথ্যই যে জানা হয়ে গিয়েছে, এমন নয়৷ যে যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি, তার বাইরে যে আরও কিছু করার নেই, তা-ও এখনও বলা যাচ্ছে না৷ সব কিছু নিশ্চিত করে বলতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে৷ সে সময় পর্যন্ত অতিমারিও হয়তো থাকবে, যদিও তার প্রকোপ কমবে৷
কোভিড-১৯ কি আবার ফিরে আসতে পারে?
অবশ্যই পারে৷ কারণ বিভিন্ন ঋতুতে সে যে কী রূপ নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না৷ তবে তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা বাড়লে যদি সংক্রমণের আশঙ্কা কমে, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় কিছুটা মুক্তি হয়তো পাওয়া যাবে৷
প্রকোপ কতটা কমলে বলা যাবে যে অতিমারি কমছে?
মহামারি বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্লুয়ের মরসুমে ইংল্যান্ডে প্রতি বছর গড়ে ৮০০০ জনের মতো মারা যান৷ কোভিড ১৯-এ যদি ওই রকম সংখ্যকই মারা যান, তা হলে ধরে নিতে হবে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণে আছে৷ ভ্যাকসিন এসে গেলে অবশ্য আলাদা কথা৷
মহামারি বিশেষজ্ঞরা কীসের উত্তর খুঁজছেন?
মহামারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুইটি-র মতে, এই মুহূর্তে সব চেয়ে বেশি জানা দরকার যে সংক্রামিত হওয়ার পর কত জনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিচ্ছে না৷ উপসর্গ দেখা না দেওয়ার অর্থ তাঁদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে৷ এ বার যদি এই অ্যান্টিবডি ধরার মতো কোনও নির্ভরযোগ্য পরীক্ষার পন্থা, যাকে বলে সেরোলজিকাল পরীক্ষা বার করা যায়, কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই অনেক বেশি জোরদার হবে৷ কারণ, তখনই একমাত্র জানা যাবে, পরের বার যদি সংক্রমণ হয়, শরীরে এই অ্যান্টিবডি থাকার ফলে কারা কারা নিরাপদ থাকবেন আর কারা থাকবেন না৷ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া তখন অনেক সহজ হবে৷
ওষুধ বা ভ্যাকসিন ছাড়া আর কী ভাবে এর প্রকোপ কমানো যাবে?
দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ যে দ্রুত কমেছে তার মূলে আছে তাদের নিজস্ব মডেল৷ গণহারে পরীক্ষা করা ও সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে রোগের আশঙ্কা আছে এমন মানুষকে আইসোলেট করে ফেলা এবং রোগীদের অতি উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়া৷ ব্যাপারটা মারাত্মক ব্যয়বহুল হলেও এই পথেই লুকিয়ে আছে মহামারির উত্তর, জানিয়েছেন অধ্যাপক হুইটি৷ নেচার জার্নালেও এই মডেলের প্রভূত প্রশংসা করা হয়৷ যদিও অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল এই পন্থাটি আমাদের দেশের পক্ষে আকাশকুসুম কল্পনামাত্র৷
অতিমারি হতে চলেছে তা বোঝার রাস্তা
এই ভাইরাস ক্রমাগত নিজের জেনেটিক কোড পাল্টে চলেছে, যাকে বলে মিউটেশন৷ এ বার সিকুয়েন্সিং টেকনোলজির সাহায্যে এই কোডকে পড়ে ফেলা গেলে বোঝা যাবে মহামারির উৎস আঞ্চলিক না সে এসেছে বাইরে থেকে৷ বর্তমানে ব্রিটেন সরকার এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোভিড-১৯ জেনোমিকস ইউকে কনসোর্টিয়ামকে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে৷ গবেষণাও এগিয়েছে অনেক দূর৷ করোনা পরিবার ও তাদের চরিত্র বদলানোর অনেক খবরই এসে গিয়েছে বিজ্ঞানীদের হাতে৷
করোনাভাইরাস সংক্রমণ
কী ভাবে মানুষকে সংক্রামিত করে
ভাইরাসের শরীরে যে কাঁটার মতো প্রোটিন আছে, সে মানব-কোষে ঢুকে তার প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়৷ ভাইরাসের গায়ে যে ফ্যাটের লেয়ার থাকে তা কোষের বহিরাবরণের সঙ্গে জুড়ে যায়৷ মিলেমিশে এক হয়ে যায় ভাইরাস ও কোষ৷ ভাইরাসের জেনেটিক কোড চলে আসে শরীরের কোষে৷ অর্থাৎ, কোষের দখল চলে যায় পুরোপুরি ভাইরাসের হাতে৷ সে তখন বাড়তে থাকে নিজের ছন্দে৷ তৈরি হয় বুদবুদ৷ একসময় ফেটে ছড়িয়ে পড়ে গলা, মুখ, ফুসফুসে৷ সে সব জায়গাতেও তখন একই রকম করে বাড়তে থাকে ভাইরাস৷
কী ভাবে তার এই অ-কাজ করার প্রবণতাকে আটকানো যায়, বিজ্ঞানীরা এই কাঁটার আণবিক বন্ধনের উপর গবেষণা করে তা খুঁজে চলেছেন৷ এর হাত ধরেই এগিয়ে চলেছে ওষুধ ও প্রতিষেধক তৈরির কাজ৷ যে গিয়ে কাঁটার সঙ্গে আটকে যাবে৷ ফলে অক্ষত থাকবে শরীরের কোষ৷
উপসর্গ
৫৫,৯২৪ জন আক্রান্ত মানুষকে পর্যালোচনা করে জানা গিয়েছে সংক্রামিত হলে—
· ৮৭.৯ শতাংশের জ্বর থাকে
· শুকনো কাশি হয় ৬৭.৭ শতাংশর
· ক্লান্তিতে ভোগেন ৩৮.১ শতাংশ মানুষ
· কফ থাকে ৩৩.৪ শতাংশের
· শ্বাসকষ্ট হয় ১৮.৬ শতাংশের
· গলাব্যথা থাকে ১৩.৯ শতাংশের
· মাথাব্যথায় ভোগেন ১৩.৬ শতাংশ মানুষ
· গাঁটে ও পেশির ব্যথা হয় ১৪.৮ শতাংশর
· কাঁপুনি থাকে ১১.৪ শতাংশের
· গা-বমি ও বমি হয় ৫ শতাংশের
· নাকবন্ধ থাকে ৪.৮ শতাংশ মানুষের
· ডায়েরিয়া হয় ৩.৭ শতাংশের৷
সবারই উপসর্গ হয়?
বিজ্ঞানীর খুঁজে চলেছেন কত জনের মৃদু উপসর্গ হয় বা একেবারেই হয় না, অথচ তাঁরা রোগ ছড়াতে পারেন৷ মোটামুটি একটা হিসেব থেকে জানা গিয়েছে, এঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষ সংক্রমণ ছড়াতে পারেন৷
কত দিন লাগে বুঝতে যে সংক্রমণ হয়েছে?
সংক্রমণ হওয়ার পর উপসর্গ দেখা দিতে মোটামুটি ২-১৪ দিন সময় লাগে, যাকে বলে ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড৷ একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, গড়ে পাঁচ দিনের মধ্যেই উপসর্গ প্রকাশ পায়৷
এটা কি মানুষ তৈরি করেছে?
না, ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স স্টাডি করে জানা গেছে ভাইরাস এসেছে প্রাকৃতিক নিয়মে৷ কোনও গবেষণাগারে তৈরি হয়নি সে৷