হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চিকিৎসকের বৈধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হল। ছবি: এপি।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) ওষুধটি সম্পর্কে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) ওষুধটি চিকিৎসকের বৈধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হল।
করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) ওষুধটি নাকি কার্যকর! এই বিশ্বাসে অজস্র মানুষ এইচসিকিউ কিনে খেতে শুরু করেছেন অ্যান্টাসিডের মতো। যদিও চিকিৎসকদের দাবি, আদৌ এটি কাজ করে কি না, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনও নেই। সে বিষয়ে এখনও বিস্তর সমীক্ষা প্রয়োজন। বরং চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া এইচসিকিউ গ্রহণ করলে নানা ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকি থাকেই। তাই এই ক্ষতিতে রাশ টানতে এমন বিজ্ঞপ্তি দিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক একপ্রকার বাধ্য হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
তবে এই বিজ্ঞপ্তিতে এইচসিকিউ কারা কারা কিনতে পারবেন, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক। যেমন:
• যে সব রোগীকে এই ওষুধ ব্যবহার করার জন্য প্রেসক্রিপশনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা তা দেখিয়ে এইচসিকিউ সংগ্রহ করতে পারবেন। চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া কোনও অবস্থাতেই কাউকে এইচসিকিউ বিক্রি করা যাবে না।
• যে সব স্বাস্থ্যকর্মী সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন বা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন, তাঁরাও চাইলে নিজেদের পরিচয়পত্র-সহ ডিউটির কাগজ দেখিয়ে এই ওষুধ কিনতে পারেন।
• কোভিড-১৯ রোগীর পরিবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছেন এমন কেউ চিকিৎসকের নির্দেশনামা দেখিয়ে এই ওষুধ সংগ্রহ করতে পারেন।
আরও পড়ুন: শুধুই ছাদে হাঁটা বা জগিং নয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও মেদ ঝরাতে করুন এ সব ব্যায়াম
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে আরও বিস্তারিত পরীক্ষা প্রয়োজন। —ফাইল চিত্র।
কী এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন?
‘ক্লোরোকুইন ফসফেট’ ম্যালেরিয়া সারানোর ওষুধ। সিঙ্কোনা গাছ থেকে এর মূল উপাদান পাওয়া যায়। ক্লোরোকুইনের হাইড্রক্সিলেটেড সল্টকে বলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এটি কাজে বা গঠনগত দিক থেকে অনেকটাই আমাদের খুব পরিচিত অন্য আর এক অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ ক্লোরোকুইনেরই মতো। ম্যালেরিয়া ছাড়াও এটি অন্য কানেক্টিভ টিস্যু ডিসঅর্ডার যেমন লুপাস, রিউম্য়াটয়েড আর্থ্রাইটিস, জোগ্রেন সিন্ড্রোম ইত্যাদি রোগে এর ব্যবহার হয়।
কেন নিষেধ?
অনেকের ক্ষেত্রে এই ওষুধটি হার্টের ছন্দ বিঘ্নিত করার পাশাপাশি সোরিয়াসিসের মতো ক্রনিক অসুখ বাড়িয়ে দেওয়া, ত্বকের র্যাশ, চোখের সমস্যা-সহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ডেকে আনছে। এই কারণেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক প্রেসক্রিপশন ছাড়া এই ওষুধ খাওয়া ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসের মতে, ২০০২–২০০৩ সালে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোমের (সার্স) চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য ভাল ফল পাওয়া যায়। এ বারের বিশ্ব মহামারি নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের এই ওষুধ দিয়ে লক্ষ্য করা গিয়েছে, যে এইচসিকিউ ওষুধটি কোষের পিএইচ ব্যালান্সের তারতম্য ঘটিয়ে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিতে পারে। নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ না থাকায় কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ওষুধের ডোজ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তবে এই ওষুধটি প্রয়োগ করার আগে রোগীর ইসিজি করিয়ে নেওয়া উচিত। কেননা, এইচসিকিউ ওষুধটির নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম হার্টের এক নির্দিষ্ট ছন্দ (কিউ টি) থামিয়ে দেওয়া। ইসিজি করে যদি দেখা যায়, হার্টের ইলেকট্রিক্যাল সমস্যা আছে, তা হলে এই ওষুধটি না দেওয়াই ভাল। অরিন্দমবাবু জানিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে হার্ট বন্ধ হয়ে আকস্মিক মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।
আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় বিত্তবান দেশগুলি যা পারেনি ভারত তা করে দেখিয়েছে: কুণাল সরকার
চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া এইচসিকিউ গ্রহণ করলে নানা ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকি থাকে। ছবি: রয়টার্স।
এই ওষুধটির আর একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রেটিনোপ্যাথি। তাই রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এসএলই-সহ অন্যান্য অসুখে যাঁদের দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে এইচসিকিউ খেতে হয়, তাঁদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা দরকার।
‘হু’-এর নির্ধারিত সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় ম্যালেরিয়ার কুইনাইন নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকার কারণেই ‘নিরাপদ’ হিসেবে ‘হু’ গণ্য করে না। বক্ষবিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্তও এই মতের সঙ্গে একমত। তাঁর কথায়, “এই ওষুধের যত না কাজ, তার চেয়ে সাইড এফেক্টস অনেক বেশি।”
প্রেশক্রিপশন মেনে খেলেও বমি বমি ভাব, মাথার যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা, পেট ব্যথা, ওজন কমে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো ছাড়াও কিছুটা মানসিক অবসাদের জন্ম দিতে পারে এই ওষুধ। এই ওষুধের জেরে বুকে চাপ ধরা ভাব ও বুকে ব্যথা, কাশি ও গলা ধরে যাওয়া, প্রস্রাবের রং বদলে যাওয়া ও প্রস্রাব কমে যাওয়া, ডায়েরিয়া, শ্বাসকষ্টও দেখা যায়। এত সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ওভার দ্য কাউন্টার এই ওষুধ কিনে খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার। আর এই কারণেও প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে কেন্দ্র সরকারের স্বাস্থ্য দফতর থেকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, যে তিন সপ্তাহ আগেই আমাদের রাজ্যে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এইচসিকিউ বিক্রি করা ও কেনা বন্ধ করা হয়েছে। একে তো কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়, আবার চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগ প্রতিরোধে এই ওষুধ আবশ্যক। সুবর্ণবাবু জানালেন, ‘‘রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস, লুপাস রোগীদের নিয়মিত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেতে হয়। কোভিড-১৯ আটকাতে সবাই যদি চাল-ডালের মতো এই ওষুধ কিনে বাড়িতে মজুত করতে শুরু করেন তা হলে নিজেদের উপকার তো হবেই না, আবার প্রকৃত যাঁদের দরকার, তাঁরাও ওষুধটি পাবেন না। ফলে ভেঙে পড়তে পারে স্বাস্থ্য পরিষেবাও।’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)