corona virus

অতীতের মহামারির এই সব বিষয় মাথায় রাখুন, কমবে আতঙ্ক

অতীতের মহামারি থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে?

Advertisement

সুজাতা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২০ ১৪:৩৩
Share:

অতীতের মহামারি থেকে নিতে হবে শিক্ষা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

করোনা নিয়ে সবাই এই মুহূর্তে আশঙ্কাগ্রস্ত, কিন্তু অতীতে একটু চোখ বোলালেই দেখা যাবে, অতিমারি কোনও নতুন ব্যাপার নয়। গত কয়েক বছরে সেভাবে তার দেখা পাওয়া যায়নি বলে মানুষ তাকে ভুলে গিয়েছিল, এই যা। কিন্তু অতিমারি ভাল করে বুঝিয়েছে, শিখিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করলে কী হয়, প্রকৃতিকে অবহেলা করলে কী হয়। তার পর কখনও নিজের খেয়ালে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কখনও বা এসেছে ঘুরে ঘুরে। প্রচুর প্রাণ নিয়ে এক সময় বিদায় নিয়েছে। করোনা তথা কোভিড পর্বে প্রবেশের আগে, আসুন অতীতের মহামারীর সঙ্গে একটু পরিচয় করে নেওয়া যাক। ফলে অতীতের মহামারি থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যাবে।

Advertisement

প্লেগ

প্লেগের সঙ্গে আম-বাঙালির পরিচয় সাহিত্যের মাধ্যমে। কিন্তু তার আসল উদ্ভব আরও অনেক অনেক আগে। প্রথম বার আনুমানিক ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে। ছারখার করে দেয় এথেন্সকে। তিরিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান। তবে এই মহামারির কারণ প্লেগই ছিল, না অন্য কিছু তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে।

Advertisement

দ্বিতীয়বার ৫৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে। সে সময়ে রোমে রাজত্ব করছেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান। বাইজানটিয়াম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে রোগের সূত্রপাত হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। ইঁদুর থেকে মাছির মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ। এক শস্যবাহী জাহাজে চড়ে মিশর থেকে সে পৌঁছয় বাইজান্টিয়ামে। সেখান থেকে সারা ইউরোপে। কেন, কী হচ্ছে, তা বুঝতে বুঝতে শুরু হয়ে যায় মৃত্যু। দিনে প্রায় ৫০০০ মানুষ মারা পড়তে থাকেন। ইউরোপের জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়ে সে বিদায় নেয়। মারা যান ১০ কোটি মানুষ।

আরও পড়ুন: আদৌ কি দ্বিতীয় বার করোনা সংক্রমণ হতে পারে? কী বলছেন চিকিৎসকরা?​

প্লেগের তৃতীয় ভয়াবহ রূপ দেখা যায় ১৮৬০ সালে। চিনের উহানে শুরু হয়ে দেশের প্রধান শহরগুলির মধ্যে দিয়ে তা বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। থেকে যায় প্রায় দু-দশক। ১৮৯০ সালে প্রতিষেধক বেরনোর পর এর প্রকোপ কমতে থাকে। তবে তার আগেই প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। বিপদ আসে আবার। ১৯১০ সাল নাগাদ চিনের মাঞ্চুরিয়ায় আবার মহামারি হয়। মাত্র দু'বছরে মারা যান ষাট হাজার মানুষ।

স্মল পক্স, ইয়োলো ফিভার, পোলিও

স্মল পক্সও ঠিক প্লেগের মতো বাড়াবাড়ি শুরু করে। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোতে দু'বছরে প্রায় আশি লক্ষ মানুষ মারা যান। ১৬৩৩ সালে ম্যাসাচুসেটসে রোগটি ফের ছড়িয়ে পড়ে। মারা যান প্রায় দু'কোটি মানুষ। আঠারো শতকের শেষ ভাগে পক্সের টিকা বের হয়। ১৯৭০ সালে ভারতে এই রোগে প্রায় লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হন। তার বছর পাঁচেকের মধ্যে রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে।

১৭৯৩ সালে ফিলাডেলফিয়ায় ইয়োলো ফিভারে মারা যান প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ।

১৯১৬-তে হয় পোলিও মহামারি। মারা যান লক্ষ লক্ষ মানুষ। বিশ শতকের মাঝামাঝি পোলিও-র টিকা আবিষ্কার হওয়ার পরে অনেক দেশই পোলিওমুক্ত হতে পেরেছে।

আরও পড়ুন: সত্যিই অ্যাসিডিটি হয়েছে কিনা জানেন? মুঠো মুঠো অ্যান্টাসিড খাচ্ছেন যে!

স্প্যানিশ ফ্লু

এর পর আসে স্প্যানিশ ফ্লু। নামে স্প্যানিশ ফ্লু হলেও এই রোগের সূত্রপাত কিন্তু স্পেনে হয়নি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ইংল্যান্ড হয়ে সে স্পেনে পৌঁছায়। আক্রান্ত হন স্পেনের রাজ পরিবারের সদস্যরা ও আরও অনেক বিশিষ্ট মানুষ। সে সব খবর বেশ ফলাও করে বাইরে আসতে থাকায় মানুষ ভাবেন, রোগটি বুঝি স্পেন থেকেই ছড়িয়েছে।

১৯১৮-১৯২০-র মধ্যেই পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে গ্রাস করে নেয় এই মহামারি, মারা যান কোটি কোটি মানুষ, কম করে ৫-১০ কোটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যান এইচ১এন১ ভাইরাসের এই মারাত্মক প্রজাতির আক্রমণে।

ভারতেও এক ব্যাপার। সরকারি হিসেবে ১.৭-১.৮ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। বিখ্যাত হিন্দি লেখক ও কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠির লেখা থেকে জানা যায়, সে সময় রাস্তায়, অলিগলিতে পড়ে থাকত মৃতদেহর স্তুপ, গঙ্গায় ভেসে যেত ফুলে ওঠা মৃতদেহ। কে কার সৎকার করবে, কে কাকে কবর দেবে, তার কোনও ঠিক নেই, সবার ঘরেই তো রোগ!

এই মহামারিতে মহিলারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বেশি। কারণ তাঁরা অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায় ভুগতেন। বদ্ধ, অস্বাস্থ্যকর ঘরে কাটাতেন দিনের বেশির ভাগ সময়। তাঁর উপর তাঁদের হাতেই ছিল রোগীর সেবার ভার। ফলে বাড়ির পুরুষটি যদি বা সুস্থ হয়েছেন, মহিলারা মারা গিয়োছেন নির্বিচারে। সঙ্গে কমবয়সিরাও। ভাগ্যের ফেরে এই সময়ই শুরু হয় ভয়াবহ খরা। গ্রাম থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ দলে দলে আসতে থাকেন শহরে। পরিণতি কী হয়, সহজেই অনুমেয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে টেস্টের সংখ্যা আরও বাড়াবে হবে, বলছেন চিকিৎসকেরা। ফাইল ছবি

বিদেশি সরকার সমস্যা সমাধানে তেমন কোনও চেষ্টাই করেননি। ডাক্তারের অভাব ছিল অতি মাত্রায়। তার উপর দেশের মানুষ জাত খোয়ানোর ভয়ে সেটুকু সুযোগও নেননি প্রায়। জড়িবুটি, ভেষজ, হোমিওপ্যাথিই ছিল তাঁদের ভরসাস্থল। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের গণ্যমান্য মানুষেরা এগিয়ে আসেন এ সময়। গঠিত হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা কমিটি। এগিয়ে আসে অসরকারি সংস্থাও । তাঁরা একদিকে যেমন ওষুধ, ডাক্তার, খাবার ও মৃতদেহ সরানোর ব্যবস্থা করেন, চালু করেন কিছু অনুশাসন, যেমন-

• সব রকম জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দূরে থেকে কথা বলার অভ্যাস।

• দিন-রাতের অধিকাংশ সময় ঘরে থাকতে বলা হয়েছিল।

• খেতে বলা হয়েছিল পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ জল।

• বদ্ধ ঘরে না ঘুমিয়ে খোলা জায়গায় ঘুমাতে বলা হয়েছিল।

• বলা হয়েছিল সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ।

• শরীরচর্চা ও উদ্বেগ কম রাখার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হয়। চালানো হয় নজরদারি। উদ্বেগ কমেও আসে। কারণ মানুষ বোঝেন, বিপদে তাঁদের পাশে থাকার মতো মানুষ আছেন।

এর পাশাপাশি দীর্ঘদিন রোগের সঙ্গে সহাবস্থান করার ফলে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে মানুষের। সব মিলিয়ে শেষরক্ষা হয় কোনও মতে।

অতীতের ফ্লু মহামারির সময়ও মানুষ লড়াই করেছে। নিয়ম মেনে চলেছে। ফাইল ছবি

এডস ও অন্যান্যরা

১৯৮৪-তে আমেরিকায় প্রায় ছ'হাজার মানুষ এডসে মারা যান। বর্তমানে গোটা বিশ্বে এডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ। মারা গেছেন কয়েক কোটি।

একবিংশ শতকের শুরুতে চিকিৎসকদের ঘুম উড়িয়েছিল সার্স। প্রতিকারের উপায় হিসেবে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি জমায়েত নিষিদ্ধ হয়েছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় রোগটি ছড়িয়ে পড়ে ২০০৩ সালে। তবে ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে খুব বেশি মানুষ মারা যাননি এতে। এর পরে একে একে দাপট দেখিয়েছে মার্স, সোয়াইন ফ্লু, কলেরা, হাম, ইবোলা। বিভিন্ন সময়ে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ২০১৪-য় পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা জ্বরে প্রায় ১২ হাজার মানুষ মারা যান।

তাহলে...

চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলছেন, ''যে সময় ভাইরাস মারার ওষুধ তো দূরস্থান, অ্যান্টিবায়োটিক পর্যন্ত ছিল না, ভেন্টিলেটর তো দূরস্থান, গুরুতর রোগীর চিকিৎসার সাধারণ সরঞ্জামও কিছু ছিল না, সে সময় নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনেই মানুষ প্রাণে বেঁচেছে, বহু মানুষের রোগ ঠেকানো গিয়েছে।''

তা হলে আজকের এই উন্নত প্রযুক্তির মাঝে থেকে, যেখানে সরাসরি ভাইরাস মারার ওষুধ না থাকলেও, ভাইরাসের প্রভাবে যা যা ক্ষতি হয়, তাকে সামলানোর ব্যবস্থা আছে, সেখানে আশ্বস্ত থাকার কারণ যথেষ্ট।

চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর কথায়, সবচেয়ে বড় কথা, অন্য রোগগুলির তুলনায় কোভিড অত মারাত্মক নয়। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হওয়ার পর নিজে নিজেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন, অনেকেই জানতেই পারছেন না এই রোগ হয়েছিল বলে, ২০ শতাংশের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, তার মধ্যেও প্রায় অনেকেই সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছেন, বাকিদের জটিলতা হলেও তা সামলানো যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, মারা যান ১-৩ শতাংশ মানুষ। বেশির ভাগই বয়স্ক কিংবা অন্য কারণে গুরুতর অসুস্থ। তা হলে এত আতঙ্ক কেন? একে হারিয়ে যে আমরা জয়ী হব, এ কথা নিশ্চিত। তাই সাবধানে থাকুন, তবে আতঙ্ক নয়। শিক্ষা নিতে হবে অতীতের মহামারি থেকে।"

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। ছবি:শাটারস্টক

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement