রংবাহারি চন্দ্রমল্লিকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’তে নিখিলেশ জানিয়েছিল, নানা টবে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকায় সে তার বাগান সাজিয়েছিল। আর গাছে ফুল এলে মনে হত, ‘সবুজ সমুদ্রে ঢেউ লেগে নানা রঙের ফেনা উঠেছে।’ চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গতে আপনার বাড়ির বাগানে বা একচিলতে মাটিতেও কিন্তু এমন রঙের বোল ফুটতে পারে, অন্তত এই শীতের মরসুমে। তবে সে জন্য কয়েকটি খুঁটিনাটির দিকে খেয়াল রাখলে ভাল।
ফুলের প্রকারভেদ
বলা হয়, বড়দিনের সময়ে এই ফুল সবচেয়ে বেশি ফোটে। তাই চন্দ্রমল্লিকার ইংরেজি প্রতিশব্দ, ‘ক্রিস্যানথিমাম’। গ্রিক ভাষায় অবশ্য এই শব্দের অর্থ, ‘সোনালি ফুল’। অথচ, চিন ও জাপানে এই ফুলের জন্ম। এর নানা প্রজাতি, স্নোবল, চন্দ্রিমা, সোনার বাংলা, স্টার, পমপম, কুইন অব তমলুক প্রভৃতি। হুগলির বলাগড় ব্লকের জিরাট এটির চারা বানানোর জন্য বিখ্যাত। মূলত ‘কাটিংয়ের’ সাহায্যে তৈরি হয় নতুন চারা। এখন মিউটেশনের সাহায্যে ফুলেও নতুনত্ব আনা হচ্ছে।
গাছ লাগানোর আগে যা
জানা জরুরি
যে প্রজাতিরই হোক না কেন, চন্দ্রমল্লিকার দরকার পর্যাপ্ত সূর্যালোক। তাই যেখানে চারা রোপণ করা হবে, সেখানে ঠিক মতো রোদ আসছে কি না, তা আগাম দেখে নিতে হবে। হর্টিকালচারিস্ট পলাশ সাঁতরা বলছেন, “বাড়িতে এই গাছ লাগালে, তা চারা থেকেই শুরু করা উচিত। কারণ, বীজ থেকে এই গাছ বড় করতে গেলে অনেক সময়েই গাছ ও ফুলের মান ভাল হয় না। সাধারণত, মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে এই গাছ বসানো যায়।”
তবে চারা লাগানোর আগে মাটি ভাল ভাবে তৈরি করাটা জরুরি। সে জন্য প্রথমে শুকনো মাটি গুঁড়ো করে তাতে গোবর সার, নিম খোল, বাদাম খোল, সামান্য পরিমাণে মহুয়া খোল মেশাতে হবে। তিন মাস মতো এই মাটি রাখার পরে চারা রোপণ করলে গাছের গঠন ভাল হবে। উন্নত হবে ফুলের মানও। সে সঙ্গে, টবে গাছ লাগানোর আগে টব-প্রতি এক চামচ ইউরিয়া, এক থেকে দু’চামচ পটাশ দিলে ভাল। গাছ লাগানোর ২৫ দিন পরে আরও এক চামচ ইউরিয়া দেওয়া দরকার। গাছের গোড়া থেকে কিছুটা দূরত্বে মাটির উপরে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। সঙ্গে কীটনাশক যোগ করাটাও জরুরি।
পাশাপাশি, গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে টব পাল্টানোটা অবশ্য কর্তব্য। গাছ ছোট থাকার সময়ে ছোট টব। কিন্তু তা বড় হওয়ার সময়ে, ১৫-২০ দিনের ব্যবধানে দু’বার মাপ অনুযায়ী বড় টবে স্থানান্তরিত করতে হবে। টবের বদলে, সরাসরি মাটিতে চন্দ্রমল্লিকার চারা লাগালে, খেয়াল রাখতে হবে একটির সঙ্গে অন্যটির দূরত্ব যেন ২৫-৩০ সেন্টিমিটার থাকে।
কাটিংয়ের সময়ে
গাছে এক বার ফুল এসে গেলে ‘মা’ গাছটির থেকে ডালের কিছু অংশ কেটে পরের বারের জন্য নতুন করে বড় করা যেতে পারে। পলাশ সাঁতরা জানাচ্ছেন, মার্চ পর্যন্ত ফুল দেওয়ার পরে গাছটিকে ছায়ায় রাখতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে, যাতে রোদ-বৃষ্টির ছোঁয়া না লাগে। মে, জুন পর্যন্ত নতুন ডালপালা গজালে মাটি থেকে ১৫-২০ সেন্টিমিটার সমান গাছটি রেখে বাকি অংশ কেটে নিতে হবে। জল দেওয়ার সঙ্গে মাঝে-মাঝে নিম তেলের মতো কীটনাশক দেওয়া জরুরি। নতুন ডালপালা গজালে সাত সেন্টিমিটারের বেশি বড় হলেই তা কেটে দিতে হবে। এগুলিকে ছোট টবের মধ্যে বসিয়ে দিলে কিছু সময় পরে শিকড় বেরোয়।
নাগালে ফুলের আকার
ফুলের মান ভাল রাখতে প্রথমে কুঁড়ি এলে তা ‘ডিবাডিং’ অর্থাৎ কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন পলাশ। তিনি জানাচ্ছেন, প্রথম বারের কুঁড়ি না কেটে ফেললে ফুলগুলি খুবই ছোট হবে। আর সংখ্যাতেও খুব বেশি হবে না। কুঁড়ি কেটে দিলে সেখানে তৈরি হবে নতুন ডালপালা। সঙ্গে বাড়বে ফুলের মান ও সংখ্যাও। এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় ‘ব্রাঞ্চিং’। পমপমের মতো ছোট জাতের ফুলের জন্য এটি খুবই জরুরি। তবে যদি বড় মাপের ফুল পছন্দ হয়, তবে এই পদ্ধতিটি কম করতে হবে।
গাছের যত্নে
এবার আপনার শীতের বাগান সেজে উঠুক ফুলের বাহারে।
ঐশী চট্টোপাধ্যায়