Michelin Star

যদি হও সুজন, শিকাগোতেও স্বজন, জন্ম কল্যাণীতে, কর্ম আমেরিকায়, দেশি খাবার খাইয়ে বিদেশে ‘তারা’ বাঙালি

ফুটবলে স্বীকৃতি বিশ্বকাপ। সাহিত্যে নোবেল। রান্নার ক্ষেত্রে তেমনই হল মিশেলিন তারকা। কল্যাণীর আদি বাসিন্দা বাঙালি সুজন সরকার সেই তারকাই পেয়েছেন।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩১
Share:

শেফ সুজন সরকার। ছবি: সংগৃহীত।

আমেরিকায় ছ’-ছ’টা রেস্তরাঁ তাঁর। নবতমটি লাভ করেছে ‘রান্নার অস্কার’। কল্যাণীর ছেলে, শিকাগোর সেই শেফ অবশ্য ফোনে বলেন, ‘‘লেখাপড়ায় তো বিশেষ ভাল ছিলাম না। আমার থেকে কারও বেশি আশা ছিল না। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হব কেউ আশাও করেননি।’’

Advertisement

ফুটবলে স্বীকৃতি বিশ্বকাপ। সাহিত্যে নোবেল। রান্নার ক্ষেত্রে তেমনই হল মিশেলিন তারকা। কল্যাণীর সুজন সরকার সেই তারকাই অর্জন করেছেন।

সুজনের তৈরি ঝালমুড়ি বার। ছবি: সংগৃহীত।

এক সময়ে মাত্র হাজার তিনেক গাড়ি ছিল গোটা ফ্রান্সে। মিশেলিনদের সংস্থা গাড়ির টায়ার বানাত। নিজেদের ব্যবসা বাড়াতেই নতুন ভাবনা এসেছিল দুই মিশেলিন ভাইয়ের মাথায়। গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরোলে কোথায় গিয়ে মনের মতো খাবার খাওয়া যাবে, তা চেনাতে কিছু রেস্তরাঁকে ‘মিশেলিন স্টার’ খেতাব দিতে শুরু করেন তাঁরা। সে ছিল বিশ শতকের গোড়ার কথা। শতাব্দী পেরিয়ে মিশেলিন তারকা নানা দেশে ছড়িয়েছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশেও দেওয়া হয়। তবে ভারতে এখনও আসেনি।

Advertisement

এই তারকা লাভের জন্য কী না করেন বিশ্বখ্যাত রাঁধুনিরা! সারাজীবন চেষ্টা করেন। না পেলে আত্মহত্যাও করেন।

অন্য দেশে কাজ করে এর আগে এই খেতাব জনা চারেক ভারতীয় পেয়েছেন। তার মধ্যে এক জনই শুধু বাঙালি। আর সুজন হলেন প্রথম বাঙালি শেফ যিনি এই তারকা পেলেন। ফরাসি ছোঁয়ায় ভারতীয় রান্না খাইয়ে মিশেলিন জিতেছে তাঁর শিকাগোর রেস্তরাঁ ‘ইন্ডিয়েন’।

মিশেলিন তারকা লাভ করেছে শিকাগোর এই রেস্তোরাঁ। নাম ‘ইন্ডিয়েন’। ছবি: সংগৃহীত।

গত ২০ বছর ধরে শেফ হিসাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে কাজ করেছেন সুজন। কল্যাণী ছেড়েছেন পান্নালাল ইনস্টিটিউশন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরেই। তার পরে ভুবনেশ্বরে কলেজ সেরে গোয়া-মুম্বই-দিল্লি হয়ে লন্ডন। সেখানেই কেটেছে অধিকাংশ সময়। হাত পাকিয়েছিলেন ইউরোপীয় রান্নায়। তবে নিজের রেস্তরাঁ তৈরির ভাবনা যখন আসে, তখন মনে হয়েছিল ভারতীয় খাবারই খাওয়াবেন সকলকে। সেই ভারতীয় রান্নায় অবশ্য থাকে তাঁর এত দিনের শিক্ষা ও শ্রমের ছোঁয়া। শিকাগো থেকে ফোনে আনন্দবাজার অনলাইনকে সুজন বলেছিলেন, ‘‘ফরাসি আর বাঙালিদের মধ্যে অনেক মিল আছে। ভাষা যেমন মিষ্টি, তেমন রুচিও। তাই ফরাসি ছোঁয়া রেখেছি নিজের রান্না পরিবেশন করার ব্যবস্থাপনায়।’’ এটি অবশ্য সুজনের প্রথম রেস্তরাঁ নয়। ‘ইন্ডিয়েন’ চালু করেছেন সবে গত বছর। ২০১৭ সালে সান ফ্রান্সিস্কো শহরে প্রথম রেস্তরাঁ ‘রুহ্‌’ চালু করেন তিনি। এখন সেটির দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর ভাই পূজন সরকার। পূজনও শেফ। থাকেন সে দেশেই।

সুজনরা তিন ভাই। তিনিই বড়। প্রথম দুই ভাই শেফ। ছোট ভাই মার্চেন্ট নেভিতে। বাবা কল্যাণীর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। দাদু ডাক্তার। কাকা ইঞ্জিনিয়ার। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে স্কুল পাশ করেছেন সুজন। এ দিকে, তিন ভাইয়ের এক জনও বাবা-কাকা-দাদুর পথে হাঁটেননি। এ-ও সম্ভব! এত বছরে বাংলা বলার অভ্যাস খানিক খুইয়েছেন। পরিচিত পথে হাঁটার বাঙালি স্বভাবের ধার যে ধারেননি, তা তো আগেই দেখিয়েছেন। খানিক ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন, ‘‘অত লেখাপড়া তো করতাম না কখনও। সব সময়েই বরং শিল্পকলায় মন ছিল।’’ চেয়েছিলেন পোশাকশিল্পী হবেন। তা হয়ে ওঠেনি। সেই জায়গায় হলেন রন্ধনশিল্পী। এবং নিজে প্রথম মিশেলিন তারকা পেলেও এর আগে তাঁর হাতে গড়া অন্যান্য রেস্তরাঁ দিব্যি সে খেতাবে ভূষিত হয়েছে।

বাটার চিকেনে সুজন-পরশ। ছবি: সংগৃহীত।

মায়ের সঙ্গে কি কথা হয়েছে মিশেলিন জয়ের পরে? বাঙালি মা কি সন্তানের রন্ধনশৈলীর কদর করেন?

সুজন অকপট। বলেন, ‘‘সত্যি বলতে কি মিশেলিনের ব্যাপারটা অনেকেই বোঝেন না। মাকেও খানিকটা বোঝাতে হয়েছে। অতিমারির পরে এক বারও এ দেশে আসতে পারেননি মা। তাই ‘ইন্ডিয়েন’ দেখেননি এখনও।’’ মিশেলিন জয় নিয়ে অবশ্য অত উচ্ছ্বাসেও মন নেই বাঙালি মায়ের এই সন্তানের। মনে করেন, খেতাবের থেকে কাজ অনেক বেশি জরুরি। তবে আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে প্রায় সকলেই জেনে যান অন্যদের জীবনের খুঁটিনাটি। তাঁর কর্মজীবনে যে নতুন পালক জুড়েছে, তা ইতিমধ্যেই জেনেছেন কলকাতার বন্ধুরা। তাঁরা যখন হইচই করেন, তখন মন্দ লাগে না বাঙালি শেফের।

ভাষায় বাঙালিয়ানা খানিক চলে গেলেও মন কিন্তু এখনও ভেতো। মায়ের হাতের রান্না খেতে সব সময়ে দেশে আসা না হলেও ভাইয়ের হাতের রান্না খান। মাঝেমধ্যেই উড়ে যান সান ফ্রান্সিস্কোয় ইলিশ মাছ বা ঝিঙে পোস্ত খেতে। বলেন, ‘‘বয়স ৪৫ হল। এমন বয়সে আরও অনেকের মতো আমিও রোজ রোজ ভাতের অভ্যাস ছেড়েছি। কিন্তু মনেপ্রাণে ভেতো। যতই ইউরোপীয় রান্না করি, দিনের শেষে মাছ-ভাত খেতে দারুণ লাগে।’’ তবে স্ত্রী ওড়িশার মেয়ে। আর নিজেও বেশি বাঙালি রান্নায় মন দেননি আগে। মা থাকেন দূরে। তাই বাঙালি রান্নায় পটু ভাই-ই ভরসা।

ভারতীয় মিষ্টি ফরাসি বেশে। ছবি: সংগৃহীত।

এখন অবশ্য বাঙালি খাবার নিয়েও বিশেষ চর্চা করছেন সুজন। ইতিমধ্যেই কিনুয়া দিয়ে ঝালমুড়ি বার আর সি-আর্চিন দিয়ে মালাইকারি খাওয়ানো শুরু করেছেন ‘ইন্ডিয়েন’-এর অতিথিদের। ধীরে ধীরে বাঙালি স্বাদের সঙ্গে অতিথিদের আরও নানা ভাবে পরিচয় ঘটানোর ইচ্ছা আছে তাঁর।

আর কলকাতা? সুজনের কোনও রেস্তরাঁ তৈরি হবে কি এ শহরে? ইচ্ছা থাকলেও এখনও উপায় বার করতে পারেননি শেফ। বলেন, ‘‘আসলে রেস্তরাঁ শুধু খুললেই তো হয় না। নিয়মিত দেখাশোনা করতে হয়, অন্যান্য ব্যবসার মতোই। তাই ইচ্ছে থাকলেও এখনও কলকাতায় কিছু করার পরিকল্পনা করে উঠতে পারিনি মূলত দূরত্বের কারণেই।’’ তবে কলকাতা আর কল্যাণীতে নিয়মিত আসেন তিনি। বছরে কয়েক বার। বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করার ভাবনা নেই মোটেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement