যৌনপল্লি থেকে সংগ্রহ করা ২২২ ইউনিট রক্ত ফেলে দিচ্ছে দুই সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক।
নিময়কানুনের তোয়াক্কা না করেই সোনাগাছি এবং হাড়কাটা গলিতে রক্তদান শিবিরের অনুমতি দিয়েছিল মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ব্লাড ব্যাঙ্ক। আনন্দবাজার-এ এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি চায়। বৃহস্পতিবার দুই ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ওই দুই শিবির থেকে সংগ্রহ করা ২২২ ইউনিট রক্ত আলাদা করে রাখা হয়েছে। কোনও রোগীকে তা দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে কোনও যৌনপল্লির দুই কিলোমিটারের মধ্যে যাতে রক্তদান শিবিরের আয়োজন না হয়, সে ব্যাপারেও যথাসাধ্য ‘চেষ্টা’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁরা।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনও যৌনপল্লির ভিতরে বা তার এক কিলোমিটারের মধ্যে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা নিষিদ্ধ। একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে এইচআইভি বা অন্য নানা যৌন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বলেই এই ধরনের সতর্কতাবিধি চালু করেছে কেন্দ্রীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদ। যারা নিয়মিত মাদক সেবন করেন, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক নেন, তাঁদের শরীর থেকেও রক্ত নেওয়া নিষিদ্ধ। সোনাগাছি বা হাড়কাটা গলি, দুই জায়গাতেই স্থানীয় ক্লাবের বকলমে শিবির অনুষ্ঠিত হলেও তার পৃষ্ঠপোষক ছিল শাসক দল তৃণমূল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে দুই ব্যাঙ্কের কর্তারা দাবি করেছিলেন, শাসক দলের চাপে পড়েই তাঁরা অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে এ দিনের প্রতিশ্রুতিও ভবিষ্যতে কতটা রক্ষিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
পাশাপাশি এ দিনের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও রক্তদান আন্দোলনকে অনেকটাই ধাক্কা দিতে পারে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাঁদের মতে, সৎ কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে অনেক সময় লাগে। এখন পরিস্থিতি এমনই যে সব কিছুর গায়েই রাজনৈতিক রং। ফলে পরবর্তী সময়ে রক্তদান শিবিরে যাওয়ার আগে বহু মানুষ দু’বার ভাববেন। তাঁদের দান করা রক্ত কতটা সঠিক কাজে ব্যবহৃত হবে, সে নিয়েও তাঁদের মনে সংশয় থেকে যাবে।
এ দিন দুপুরে প্রথমে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন বিজেপির রাজ্য সহ সভাপতি তথা চিকিৎসক সুভাষ সরকার। সোনাগাছিতে রক্তদান শিবির করার অনুমতি এবং সেখান থেকে সংগৃহীত রক্ত সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছিলেন সুভাষবাবু। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই এ দিনের বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকের পর সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন, সে দিনের শিবির থেকে সংগৃহীত ৭২ ইউনিট রক্ত আলাদা করে রাখা হয়েছে। ওই রক্ত ব্যবহার হবে না। স্বাস্থ্য ভবনেও তাঁরা বিষয়টি ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন। যদিও ব্লাড ব্যাঙ্কেরই অন্য একটি সূত্র দাবি করছে, ইতিমধ্যেই কয়েক ইউনিট রক্ত বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে।
এ দিন কুমারেশবাবু লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা যৌনপল্লির দুই কিলোমিটারের মধ্যে এই ধরনের শিবির করার অনুমতি না দেওয়ারই চেষ্টা করবেন। তবে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অন্য কর্তারা বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতা এসে যখন বলবেন ‘অমুক দিন অমুক জায়গায় ক্যাম্প আছে, লোক পাঠিয়ে দেবেন’, তখন তাঁকে মুখের উপরে না বলার সাধ্য কার আছে? পরের দিনই তো তাঁকে সুন্দরবনে বদলি করা হবে কিংবা কম্পালসারি ওয়েটিং-এ পাঠানো হবে!’’ আর এক কর্তার কথায়, ‘‘কর্তৃপক্ষ খুব ভাল করেই জানেন যে, কতটা চাপ থাকে! ওই জন্যই ‘চেষ্টা করব’ বলেই দাঁড়ি টেনেছেন!’’
সোনাগাছিতে শিবির করার পাঁচ দিনের মাথায় হাড়কাটা গলিতেও ঐশিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। সোনাগাছির শিবিরের উদ্বোধন করেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা পেশায় চিকিৎসক শশী পাঁজা। আর হাড়কাটা গলির শিবিরটির উদ্বোধন করেন তৃণমূল সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে ১৫০ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করেছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ব্লাড ব্যাঙ্কের ইমিউনো হেপাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ। এ দিন তাঁদের সঙ্গেও বৈঠক করেন সুভাষবাবুরা। সেখানেও রক্ত ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষও চিঠি দিয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতে এমন যাতে না হয়, তার জন্য ‘চেষ্টা’ করবেন তাঁরা।
সুভাষবাবু পরে বলেন, ‘‘কী ভাবে চিকিৎসকেরা এমন অনুমতি দিতে পেরেছিলেন, তা ভেবে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককেও বিষয়টি জানাব। প্রয়োজনে কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে রাজ্যের সঙ্গে কথা বলবেন।’’ আর রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘শুধু ওই দুটি শিবিরের রক্ত ফেলে দিয়েই খুব স্বচ্ছ হওয়া গেল, এমন মনে করলে ভুল হবে। বহু শিবির হচ্ছে, যেখানে দামি উপহারের বিনিময়ে কার্যত রক্ত বিক্রি হচ্ছে। রক্ত-সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গেলে ওই ধরনের শিবিরগুলিও বন্ধ করা জরুরি।’’