আমাদের জীবনে নানা সময় আসে, যখন কোনও কাজ করতে ভাল লাগে না, নিজের ভিতরে গুটিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সেই মুহূর্তে আমরা একটা কথাতেই নিজের মানসিক অবস্থা বুঝিয়ে দিই— মুড ভাল নেই। মুড মাঝেমধ্যে অল্প-বিস্তর খারাপ হতেই পারে। সকলেরই হয়। আবার নিজে থেকেই অনেক সময় সেরে যায়। সে সব সাধারণ মনখারাপের ঘটনা। তা রোগের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু মুড ডিজ়অর্ডার এক জটিল রোগ। মনখারাপ জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় ডিপ্রেসিভ ডিজ়অর্ডার বলে।
মুড ডিজ়অর্ডারের নানা দিক, নানা লক্ষণ। যেমন, ডিপ্রেশন বা অবসাদ এক ধরনের মুড ডিজ়অর্ডার, ঠিক তেমনই আর এক ধরনের মুড ডিজ়অর্ডার হল বাইপোলার ডিজ়অর্ডার। এই নামটি অনেকেরই শোনা। কিন্তু রোগটি আসলে কী, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই।
ডিপ্রেশনের সঙ্গে এর তফাত অনেকেই জীবনে একাধিক বার হতাশায় ভুগতে পারেন। একে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন ‘রেকারেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিজ়অর্ডার’। একই মানুষের মধ্যে যদি কখনও ডিপ্রেশন, আবার কখনও ম্যানিয়া বা হাইপোম্যানিয়ার পর্ব চলতে থাকে, তাকে বলা হয় বাইপোলার ডিজ়অর্ডার ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ডিপ্রেশন হলে সাধারণত কোনও কাজে উৎসাহ পাওয়া যায় না। আগে যে কাজের মধ্যে সে আনন্দ খুঁজে পেত, এখন সেই কাজই আর ভাল লাগে না। সব সময় একটা ক্লান্তি ভাব জড়িয়ে থাকে। এর সঙ্গে ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া (প্রথমটির সম্ভাবনাই বেশি), খিদে চলে যাওয়ার কারণে ওজন কমে যাওয়া, কথা বলতে ইচ্ছে না করা, একই জায়গায় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা— এ সবও অবসাদের লক্ষণ। এ সময়ে অনেকের নিজেকে অপরাধী বলে মনে হতে পারে। মনঃসংযোগের সমস্যা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া বা সিদ্ধান্ত নিতে না-পারার মতো বিষয়গুলিও দেখা দিতে পারে অবসাদকালে। আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। বস্তুত, এই শেষ লক্ষণটি দেখা দিলে ধরে নেওয়া হয়, সে অবসাদের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছে।
ম্যানিয়া ঠিক এর বিপরীত অবস্থা। ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, এ সময়ে এনার্জি লেভেল প্রচণ্ড বেড়ে যায়। এতটাই যে, ঘুমের সে ভাবে প্রয়োজনই পড়ে না। রোগীর মধ্যে সব সময় খুশি খুশি ভাব থাকে, সে অতিরিক্ত কথা বলতে শুরু করে, আত্মবিশ্বাস হঠাৎই প্রচণ্ড বেড়ে যায়, নিজের সম্পর্কে বিরাট ধারণা পোষণ করতে থাকে, এবং সাধারণ যে কাজ, সেগুলিও বেশি বেশি করে করতে শুরু করে। যেমন— কেউ অতিরিক্ত খেয়ে ফেলে, কেউ অতিরিক্ত এক্সারসাইজ় করতে থাকে, বেশি কিনে ফেলে, সেক্সুয়াল আর্জও বেড়ে যেতে পারে এ সময়ে। একে ম্যানিয়াক এপিসোড বলে। আর এতটা চরম পর্যায়ে না গিয়ে আচরণগুলো কিছুটা মাঝামাঝি জায়গায় থাকলে, তাকে হাইপোম্যানিয়াক এপিসোড বলে। এই পর্বে রোগ ধরা পড়লে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা তুলনায় সহজ।
আর এই সমগ্র অসুখটাকেই বলে বাইপোলার ডিজ়অর্ডার। অর্থাৎ কারও যদি দশ বা কুড়ি বছরের মধ্যে কখনও ডিপ্রেসিভ এপিসোড আসে বা কখনও ম্যানিয়াক বা হাইপোম্যানিয়াক এপিসোড দেখা দেয়, তখন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন, তিনি বাইপোলার ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত কি না! ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, কেউ যদি শুধুই ডিপ্রেশনে ভোগেন, তা হলে তাঁকে বাইপোলার বলা যাবে না। কিন্তু কারও জীবনে যদি এক বারও ম্যানিয়াক বা হাইপোম্যানিয়াক এপিসোড ঘটে থাকে, তা হলে ধরে নেওয়া হবে, তিনি বাইপোলার ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বুঝেই যাবেন যে, রোগী অতীতে কোনও সময়ে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা বোঝা যায়নি।
রোগ নির্ণয়
এই রোগ যথেষ্ট জটিল। তাই নির্ণয়ের কাজটিও সহজ নয়। ম্যানিয়াক এপিসোড তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে। সেই কারণে মনোচিকিৎসকেরাও রোগী এবং তাঁর পরিবারের লোকজনকে সতর্ক করে দেন, লক্ষণ প্রকাশ পেলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। কারণ, ওষুধের তারতম্য আছে। ডিপ্রেশন হলে এক রকম ওষুধ, বাইপোলারের ক্ষেত্রে অন্য চিকিৎসা। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে এক বার দেখেই রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। চিকিৎসককে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে রোগীকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাঁর পুরনো রোগগুলি সম্পর্কে জানতে হয়। এই রোগীদের ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেশি থাকে। সাধারণ অবসাদগ্রস্তদের চেয়ে এঁরা অনেক বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হন। নেশাসক্ত হওয়ার প্রবণতাও বেশি থাকে।
এই রোগ কি সারে?
বাইপোলার ডিজ়অর্ডার দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই রোগে আক্রান্ত হলেই সব শেষ হয়ে গেল, আর সারবে না। অনেকের ক্ষেত্রেই নিয়মিত ওষুধ খেলে রোগকে ভালমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্বাভাবিক জীবনযাপনেও কোনও সমস্যা থাকে না। তবে, নিয়মিত চিকিৎসা এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। ওষুধ খাওয়ার পরেও কোনও ক্ষেত্রে রোগ মাথাচাড়া দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকই প্রয়োজন বুঝে ওষুধ পাল্টে দেবেন। কিন্তু নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া বা চিকিৎসা কোনও ভাবেই বন্ধ করা চলবে না। চিকিৎসকের কথাই শেষ কথা।
কাদের এই অসুখ বেশি হয়?
বাইপোলার ডিজ়অর্ডার মূলত কমবয়সিদের অসুখ। ডিপ্রেশন দিয়েই সাধারণত এই রোগের সূচনা। কারও বয়ঃসন্ধিকালে ডিপ্রেশন দেখা দিলে এবং বারে বারেই তা ফিরে এলে, সাধারণ চিকিৎসায় সাড়া না দিলে চিকিৎসকেরা বাইপোলারের সন্দেহ করেন। বয়ঃসন্ধি থেকেই অনেক সময়ে রোগের বিস্তার শুরু হয়, রোগ ধরা পড়ে হয়তো বেশ কিছুটা পরে। পরিবারে আগে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
এই রোগে নারী-পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার অনুপাতটি সমান। কিন্তু শুধুমাত্র ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে মেয়েদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ। সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ের বাইপোলার ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত হতে পারেন।
পরিবারের ভূমিকা
ম্যানিয়াক পর্বে ওষুধ ছাড়া গতি নেই। কিন্তু বাইপোলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ এপিসোডই ডিপ্রেশনের পর্যায়ে থাকে আর ৩০ শতাংশ ম্যানিয়াক এপিসোড। যখন রোগী ডিপ্রেশন পর্বের মধ্য দিয়ে যায়, তখন সাইকোলজিক্যাল থেরাপি খুব ভাল কাজ দেয়। স্ট্রেস বা কোনও খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে এ রোগ বেড়ে যেতে পারে। এই বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম।
সাইকো-এডুকেশনও জরুরি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত বোঝাবেন পরিবারের সদস্যদের, যাতে তাঁরা সহজেই বুঝতে পারেন, কোন সময় রোগটি সাধারণ ডিপ্রেশন বা নর্মাল মুড থেকে সুইচ করে অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে। রোগীর পক্ষে ম্যানিয়াক ফেজ়ে বোঝা সম্ভব হয় না যে, তাঁর আচরণগুলি স্বাভাবিক নয়। এই ক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হয়। তাই শুধুমাত্র রোগীকেই নয়, তাঁর পরিবারকেও নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হবে।