অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। ছবি: সংগৃহীত।
পাড়ার টিউশন, কলেজ কিংবা অফিসে যাতায়াত করতে সুবিধা হয় বলে জিন্সই পরেন অনেকে। কিন্তু কলেজপড়ুয়া তিন্নির কাছে আর জিন্স বিষয়টা ঠিক সুবিধের পর্যায়ে আটকে নেই। বরং দিনে দিনে ওই ট্রাউজ়ার্স জোড়া তাঁর ‘কমফোর্ট ওয়্যার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শুধু তিন্নি নন, তাঁর বয়সি ছেলেমেয়েরা দিব্যি সাদা কিংবা কালো টিশার্টের সঙ্গে পছন্দের জিন্সে পা গলিয়ে বিয়েবাড়ি, বন্ধুর জন্মদিন, ঘরোয়া আড্ডা কিংবা পাড়ার বন্ধুদের ঠেক— সর্বত্র চলে যাচ্ছেন। বাড়িতে চিরকাল শাড়ি আর বাইরে ঘুরতে গেলে সালোয়ার পরা তিন্নির মা বলেন, “এই গরমে জিন্সের মতো মোটা কাপড়ের ট্রাউজ়ার্স পরতে দেখে তো আমারই কষ্ট হয়। জানি না আজকালকার ছেলেমেয়েরা কী করে সারা দিন এই ‘জিনিস’ পরে থাকে!” একরকম রেগে গিয়েই তিন্নির মা আলমারি থেকে তিন্নির পুরোনো সব ট্রাউজ়ার্স বার করে ফেলেই দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ও মা! ট্রাউজ়ার্সের পিছনে কোমরের কাছে বিশেষ একটি সাল দেখে চোখ আটকে গিয়েছিল তাঁর। ‘১৮৫৩ সাল’ মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে জিন্সের জন্ম?
ফ্যাশন দুনিয়াতে জিন্সের রমরমা চিরকালই ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নকশায়, ডিজ়াইনে বদল এসেছে। জিন্স কিংবা ডেনিম, কোনওটিই এখন শুধু পরিধেয় পোশাকের মধ্যে আটকে নেই। ডেনিম কাপড় দিয়ে ব্যাগ, জামা, জুতো, টুপিও তৈরি হচ্ছে। তবে আজকের এই ‘কমফোর্ট ওয়্যার’-এর জন্ম ১৯ শতকে। ফ্রান্সের নিম্স শহরে। যদিও এ নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকেই বলেন, এই ট্রাউজ়ার্সের ‘জিন’ কাপড়ের উৎপত্তি আসলে ইটালির জেনোয়া শহরে। সেখান থেকেই এই পোশাকের নাম হয় জিন্স। মাঠঘাটে কাজ করা শ্রমিক, নাবিকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মোটা টেকসই ডেনিম কাপড়ে বানানো ট্রাউজ়ার্স। প্রথমে কিন্তু ডেনিম কাপড়ের রং নীল ছিল না। ধুলো-ময়লা, নোংরা দাগ লুকোনোর জন্য এই পোশাকে ভেষজ গাঢ় নীল রং দেওয়া হয়েছিল। যা পরে ‘ব্লু জিন্স’ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠল।
ছবি: সংগৃহীত।
১৮৫৩ সালে লেভি স্ট্রস নামে এক জার্মান ব্যবসায়ীর হাত ধরে বাণিজ্য জগতে পা রাখে জিন্স। ‘লিভাইস’ জিন্স নামকরণ হয় তার অনেক পরে। শ্রমিক-নাবিক-বণিক-সৈন্যদের পরনের আঁটসাঁট টুইল ট্রাউজ়ার্স থেকে কেতাদুরস্ত হয়ে উঠতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছে জিন্সকে। মাঝে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে মানুষ। হলিউড থেকে বলিউড, কিংবা দক্ষিণ কলকাতার পাতিপুকুর থেকে উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়া— সর্বত্র তার অবাধ যাতায়াত। বেশি দিন আগের কথা নয়; সত্তরের দশকের মধ্যভাগে বলিউডে পা রাখল জিন্স। ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ অমিতাভ বচ্চনের পরনে দেখা গেল সেই পোশাক। ঘেরওয়ালা লম্বা লম্বা পায়ের ছন্দে শুধু মহিলাদেরই নয়, ছেলেছোকরাদের মনেও ঢেউ খেলে গেল। ট্রাউজ়ার্সে বেল বটম, বেল বট্স নকশার আবির্ভাব ঘটল। আমেরিকা, ইউরোপ জুড়ে তখন ‘হিপ্পি’ সংস্কৃতির জোয়ার। ত্বকের সঙ্গে আঁটসাঁট জিন্সের উপর অ্যাসিড ওয়াশ, মেয়েদের জন্য ডেনিম স্কার্ট কিংবা আজকের রিপ্ড জিন্স পরার চল আদতে সেই সময়ে থেকেই শুরু। ‘লিভাইস’-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে ট্রাউজ়ার্সের উপর নানা রকম কারুকাজ করতে শুরু করল ‘ক্যালভিন ক্লেন’, ‘আরমানি’। নীল রং নিয়ে জনপ্রিয় হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঙের বৈচিত্র আসতে শুরু করে। ট্রাউজ়ার্সে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচটি পকেট, ধাতব বোতামের ব্যবহার সাধারণ টুইল ট্রাউজ়ার্সের ভোল পাল্টে দিতে শুরু করে।
মেটিয়াবুরুজের বিখ্যাত জিন্স গলি ঘুরে দেখলেই খানিকটা ধারণা করা যায়। জিন্স শিল্পের পীঠস্থান বলে পরিচিত এই অঞ্চল। সকাল থেকে রাত নীল রং আর মোটা ডেনিম কাপড় নিয়েই সেখানে কারবার। সরু গলি দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পাওয়া যায় মাথার উপর উঁচু তারে ঝোলানো সদ্য রং করা কিংবা অ্যাসিড ওয়াশ্ড ট্রাউজ়ার্স। বেশির ভাগই ‘হাইওয়েস্ট’। পায়ের দিকটা ‘বুটকাট’। অত উঁচু থেকে দেখে বোঝা মুশকিল তা ছেলেদের না মেয়েদের! সেখানকারই এক কর্মচারী বলেন, “বাপ-দাদাদের আমল থেকে এই কাজ করি। কত ডিজ়াইন এল-গেল! এ সব নতুন নয়। পুরনো সব ডিজ়াইনই তো ফিরে আসছে। তবে জিন্স ধোয়া অ্যাসিডের জল শরীর, পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে। কত দিন আর এই কাজ করতে পারব জানি না।”
ছবি: সংগৃহীত।
জিন্স যুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বছর হল ১৯৯০ সাল। আঁটসাট, ঘেরওয়ালা বেল বট্ম থেকে ব্যাগি, ঢলঢলে জিন্স এবং ডাংরি পরার চল শুরু এই সময় থেকেই। এই বছরের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল জিন্স ট্রাউজ়ার্সে বুট কাট। বলিউডে মেয়েদের মধ্যে জিন্স পরার রেওয়াজ শুরু করেন পারভিন ববি, জ়িনত আমনের মতো প্রথম সারির নায়িকরা। ক্রপ টপের সঙ্গে জিন্স পরার ফ্যাশন ঢুকে পড়ে সেই সময় থেকেই। মানুষের মধ্যে এই পোশাকের চাহিদা দেখে ১৯৯৮ সালে তামিল ভাষায় ‘জিন্স’ নামে একটি ছবিও তৈরি হয়। যেখানে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ঐশ্বর্যা রাই বচ্চনকে। বলিউডে জিন্স-রাজ এখনও অব্যাহত।
জন্মলগ্ন থেকে প্রায় ১৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়া এই ট্রাউজ়ার্সের বয়স বেড়েছে। কিন্তু ‘জিন্স’ পুরনো হয়নি। বরং পুরনো ডিজ়াইন নতুন কলেবরে ফিরে এসেছে। ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে ‘লিভাইস’, ‘লি’, ‘পেপে’, ‘র্যাঙ্গলার’, ‘কেলভিন ক্লেন’-এর পাশপাশি ‘জ্যাক অ্যান্ড জোন্স’, ‘জেলাস’, ‘ক্রশ’, ‘গো কালার্স’-এর মতো নামী-অনামী বহু সংস্থা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ফ্যাশনের মঞ্চ আলো করে থাকা উজ্জ্বল নক্ষত্র থেকে অফিসের নিত্য পরিধেয় এই জিন্সকে টেক্কা দিতে বাজারে অনেকেরই আবির্ভাব হয়েছে। তবে ধোপে টেকেনি। ডিজ়াইন পুরনো হবে, নকশাও বদলে যাবে। কিন্তু, আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পরেও জিন্সের বাজারে এতটুকু বলিরেখা পড়বে না।